বাংলা মাত্রই ভোজন পিয়াসী মানুষের বসবাস । আর ভোজন থাকবে কিন্তু সেই ভোজনে মিষ্টি থাকবেনা তা তো কোনভাবেই সম্ভব নয়। বাঙালির খাদ্য আহারের তালিকায় মিষ্টি এমন একটা অনবদ্য আহার যেটা ছাড়া পুরো খাবারের প্যাকেজটাই অসম্পূর্ণ। আর এই মিষ্টি ভালোবাসা না এমন মানুষ বোধহয় বিরল । কারণ মিষ্টি মাত্রই করা পাকের শুধু চিনি নির্যাস নয়। হালকা মিষ্টি কম মিষ্টি সবরকম স্বাদের মিষ্টি আমাদের এই বাংলায় বিদ্যমান । এখন গল্পটা ঠিক অন্য জায়গায় মিষ্টি মাত্রই আবার কোনো রকম হলেই হল সেটা কিন্তু একেবারেই না কারণ পশ্চিমবাংলায় বিভিন্ন জায়গায় স্পেশাল মিষ্টির জন্য বিখ্যাত।
১) কলকাতার বাগবাজারের রসগোল্লা: রসগোল্লা বাংলা তথা বাঙালীর সবথেকে প্রিয় মিষ্টি। রসগোল্লা অর্থাৎ রসের গোল্লা, দুধের ছানা দিয়ে তৈরি সাদা রঙের এক ধরনের রসের মিষ্টি। এটিতে সাধারনত চিনি রস ব্যবহার করা হয় কিন্তু শীতের মরসুমে নলেন গুড়ের তৈরি রসগোল্লাও যথেষ্ট বিখ্যাত। ছানা পাকিয়ে গরম রসে ডুবিয়ে এটি প্রস্তুত করা হয়। কলকাতার বাগবাজারের নবীন চন্দ্র দাস ১৮৮৬ সালে প্রথম নরম তুলতুলে স্পঞ্জ রসগোল্লার সৃষ্টি করেন। তাকে রসগোল্লার কলম্বাস বলা হয়। যদিও এই রসগোল্লা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও প্রতিবেশী ওড়িশার বিরোধ বহু দিনের। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রসগোল্লার জিআই ট্যাগ লাভ করে। রাজ্যের সব জেলার সব দোকানেই কম বেশি রসগোল্লা পাওয়া গেলেও বাগবাজারের স্পঞ্জ রসগোল্লার স্বাদই আলাদা। আর সেই কারনেই এটি জনপ্রিয়।
২) বর্ধমানের সীতাভোগ: বর্ধমানের সীতাভোগ বাংলার এক সুপ্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন। এটা অনেকটা বাসমতী চালের ভাতের মত দেখতে হয়। সীতাভোগের প্রধান উপাদান সীতাসের প্রজাতির গোবিন্দভোগ চাল। এই চাল গুঁড়ো করে তাতে ১:৪ অনুপাতে ছানা মিশিয়ে পরিমাণমত দুধ দিয়ে মাখা হয়।তারপর একটি ছিদ্রযুক্ত পিতলের পাত্র থেকে উক্ত মিশ্রণকে গরম চিনির রসে ফেলা হয়। এর ফলে সীতাভোগ বাসমতীর চালের ভাতের মত দেখতে লম্বা সরু সরু দানাযুক্ত হয়। এর সাথে ছোট ছোট গোলাপজাম এবং কখনো কখনো কাজুবাদাম ও কিশমিশ মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়।
১৯০৪ সালে বড়লাট জর্জ ন্যাথানিয়েল কার্জন বর্ধমানের জমিদার বিজয়চাঁদ মহতাবকে মহারাজা খেতাব দিতে বর্ধমান ভ্রমণ করেন। কার্জনের বর্ধমান আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে বিজয়চাঁদ মহতাব বর্ধমানের জনৈক মিষ্টি প্রস্তুতকারক ভৈরবচন্দ্র নাগকে একটি বিশেষ মিষ্টি প্রস্তুত করতে বলেন। ভৈরবচন্দ্র নাগ সীতাভোগ ও বর্ধমানের অপর বিখ্যাত মিষ্টান্ন মিহিদানা তৈরী করেন।
মিহিদানার প্রধান উপাদান চাল। মিহিদানা প্রস্তুতিতে সাধারণত গোবিন্দভোগ, কামিনীভোগ অথবা বাসমতী চাল ব্যবহার করা হয়। চাল গুঁড়ো করে তার সাথে বেসন এবং জাফরান মেশানো হয়। তারপর জল মিশিয়ে ঈষৎ পীতাভ একটি থকথকে মিশ্রণ তৈরী করা হয়। একটি ছিদ্রযুক্ত পেতলের পাত্র থেকে
উক্ত মিশ্রণ কড়াইতে ফুটন্ত গাওয়া ঘিতে ফেলা হয়। তারপর দানাগুলি কড়া করে ভেজে ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তুলে চিনির রসে রাখা হয়।
৩) বর্ধমানের মনোকরের কদমা: কদমা একটি শুকনো মিষ্টি বিশেষ। বাংলায় অনেক পুরনো মিষ্টির মধ্যে কদমা, বাতাসা, নকুলদানা অন্যতম। রসগোল্লা, পান্তুয়ার আবির্ভাবের পূর্বে বাংলায় অতিথি আপ্যায়নে কদমা বাতাসা দেওয়াই রীতি ছিল। এখন আর এই মিষ্টির আগের কৌলীন্যতা নেই। কেবল পূজার কাজে এখনও বহুল ব্যাবহৃত হয় কদমা। বর্তমান পূর্ব বর্ধমানের মানকর এই কদমার জন্য বিখ্যাত।
৪) জয়নগরের মোয়া: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগর শহর এই মিষ্টান্নটির জন্য খুব বিখ্যাত। জয়নগরের মোয়ার প্রধান উপাদান কনকচূড় ধানের খই, নলেন গুড়(খেজুর গুড়) ও গাওয়া ঘি। এছাড়াও ক্ষীর, পেস্তা, কাজুবাদাম, কিসমিস দিয়ে তৈরী হয় এই অতি জনপ্রিয় মিষ্টান্ন। জয়নগর শহরের পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুঁচকিবাবু এবং নিত্যগোপাল সরকারকে জয়নগরের মোয়ার বাণিজ্যিক বিপণনের পথিকৃৎ বলে ধরা হয়। মূলত শীতের মরসুমে এই মিষ্টি পাওয়া যায়।
৫) নবদ্বীপের লাল দই: নদিয়ার নবদ্বীপের লাল দই বা ক্ষীর দই বা চাক্কু দই বা মিষ্টি দই বাংলার অন্যতম প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন। দই বা দধি মিষ্টান্ন পরিবারের কুলীন সদস্য। দই সাধারনত সাদা হলেও লাল দই একটি স্বতন্ত্র উপাদেয় মিষ্টান্ন। এই দই তৈরির সময় ভাজা লাল চিনি দেওয়া হয় যা থেকে এর রং লালচে ও স্বাদে মিষ্টি হয়। ১৯৩০ সালের দিকে নবদ্বীপের জনৈক কালিপদ মোদক, মতান্তরে কালী ঘোষ, এই দই প্রথম প্রস্তুত করেন। ১৫০ বছরেরও প্রাচীন পাঁচুর মিষ্টির দোকান ‘লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ অন্যতম বিখ্যাত লাল দইয়ের দোকান। দই তৈরি করার পর দশদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
৬) চন্দননগরের জলভরা: হুগলী জেলার চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো যেমন বিখ্যাত, তেমনই বিখ্যাত এখানকার জলভরা সন্দেশ। জলভরা সন্দেশ তালশাঁস আকৃতির কড়াপাকের এক বিশেষ সন্দেশ। হুগলি জেলার সূর্যকুমার মোদক এই মিষ্টির আবিষ্কর্তা। শহরের সব দোকানেই জলভরা সন্দেশ পাওয়া যায়। স্বাদে কমবেশি সকলেই সমান। কিন্তু নামে সবার উপরে ‘সূর্য মোদক’-এর জলভরা।
এই সন্দেশ বানানোর মূল উপাদান ছানা, চিনি, গোলাপজল ও নলেন গুড়। সূর্য মোদকের দোকানে গোলাপজল আসে নিয়ম মেনে কনৌজ থেকে। কিছুটা সন্দেশ প্রথমে ছাঁচের মধ্যে দিয়ে আঙুলের চাপে একটা গর্ত করে নেওয়া হয়। সেই গর্তে গোলাপজল ঢেলে আবার সন্দেশ দিয়ে বাকিটা ঢেকে ছাঁচের মুখ বন্ধ করে দিতে হয়। এভাবেই জলভরা সন্দেশ তৈরী করা হয়।
৭) বাঁকুড়া বিষ্নুপুরের মোতিচুরের লাড্ডু’: লাড্ডু শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘লাড্ডুকা’ বা ‘লাত্তিকা’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘ছোট বল’। আর হিন্দিতে ‘মতি’ শব্দের অর্থ ‘মুক্তা’। ‘চুর’ অর্থ ‘ভাঙা’ বা ‘চূর্ন-বিচুর্ন’ করা। অর্থাৎ ‘মতিচুর’ মানে ‘মুক্তার ভাঙা গুঁড়া’। ছোট ছোট মুক্তা দানার মতো বুন্দিয়া বানিয়ে সেগুলোকে একসাথে হাতে চেপে তৈরি হয় মতিচুরের লাড্ডু। আর এইজন্যই এমন চমৎকার নামের উৎপত্তি। মতিচুরের লাড্ডু ভারত উপমহাদেশের একটি প্রাচীন মিষ্টি। এর বয়স দু’হাজার বছরেরও বেশি। মনে করা হয়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে বিহারে এই মিষ্টির উৎপত্তি হয়। তবে বাংলার বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মতিচুরের লাড্ডু বেশ বিখ্যাত।
৮) ক্যানিং – র লেডিকেনি: লেডিকেনি বা লেডি কেনি হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি জনপ্রিয় ভারতীয় মিষ্টি। এটি একটি হালকা ভাজা লালচে-বাদামী গোলাকার মিষ্টি যা ছানা এবং ময়দা দিয়ে তৈরি এবং চিনির তরল রসের মধ্যে ভেজানো থাকে। ১৮৫৬-৬২ সালের মধ্যে ভারতে গভর্নর-জেনারেল চার্লস ক্যানিংয়ের স্ত্রী লেডি ক্যানিংয়ের নামে নামকরণ করা হয় মিষ্টির এবং সকলের কাছে মিষ্টিটি লেডিকেনি নামে পরিচিত হয়।
৯) বর্ধমানের প্যারা: প্যারা সন্দেশের ইতিহাস শত বছরের পুরানো। প্রথমে শুধু দেব-দেবীর আরাধনায় মিষ্টান্নর প্রয়োজন এই উদ্দেশ্যেই সন্দেশ তৈরি করা হতো। পরবর্তীতে সর্বসাধারণের জনপ্রিয় মিষ্টান্নে পরিণত হয়েছে। মহেন্দ্রী দাস নামের এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায় তৈরি করা শুরু করেন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার ছাতনার প্যাড়া বেশ প্রসিদ্ধ।