পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক প্রানকেন্দ্র হিসেবে যে জায়গাটির নাম সবার আগে উঠে আসে সেটা অন্য কিছু নয় স্বয়ং মুর্শিদাবাদ।
মুর্শিদাবাদ একটি বাংলা,বিহার, উড়িষ্যার প্রাক্তন রাজধানী। যার প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদকুলি খাঁ।এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার একটি শহর ও পৌরসভা এলাকা।
মুর্শিদাবাদের ইতিহাস: মুর্শিদাবাদের আগের নাম ছিল মুখসুসাবাদ, লোকে বলতো মুখসুদাবাদ। তারও আগে নাম ছিল সৈদাবাদ। আইন-ই-আকবরি-তে উল্লেখ আছে- মখসুস খাঁ নামে একজন ওমরাহ ছিলেন দিল্লীর বাদশা আকবরের অধীনে রাজমহলের ফৌজদার। তার ভাই সৈয়দ খাঁ ছিলেন আকবরের অধীনে বাংলার সুবাদার (১৫৮৭- ১৫৯৫সাল)। সুবাদার সৈয়দ খাঁর নাম থেকে সৈদাবাদ হয়েছিল। সয়েরউল-মুতাক্ষরীণ এ উল্লেখ আছে তারও আগে নাম ছিল কুলাডিয়া।
মখসুস খাঁ পর্তুগীজদের বাংলা থেকে তাড়ানোর জন্য সৈন্য নিয়ে আসেন। ষোলো শতকের শেষ দশকসমূহে বাংলা এবং বিহারে দায়িত্ব পালন করেন মখসুস খাঁ। তিনি একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ করেন এবং দোকান দ্বারা একে ঘিরে রাখেন। স্থানটি তার নামানুসারে মুখসুসাবাদ বা মুখসুদাবাদ নামে পরিচিত হয়।
১৭০৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ রাজস্ব আদায় কেন্দ্র ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত করেন মুখসুদাবাদে। তারপর দিল্লীর সম্রাট ঔরঙ্গজেবের অনুমতি পেয়ে নিজের নামে মুখসুদাবাদের নাম পরিবর্তন করে রাখেন মুর্শিদাবাদ।মুর্শিদাবাদ বাংলা,বিহার ও ওড়িষার রাজধানী ছিল।
ভৌগোলিক অবস্থান: মুর্শিদাবাদ জেলা হ’ল মালদা বিভাগের একটি জেলা। এই জেলার মধ্য দিয়ে ভাগীরথী নদী বয়ে গিয়ে জেলাকে দুভাগে ভাগ করেছে। নদীর পশ্চিমের অংশ রাঢ় অঞ্চল ও পূর্বের অংশ বাগড়ি অঞ্চল নামে পরিচিত। জেলাটির মোট আয়তন ৫.৩১৪ বর্গ কিলোমিটার (২,০৬২ বর্গ মাইল) এবং জনসংখ্যা ৭১.০২ লক্ষ। এই জেলার সদর দপ্তর বহরমপুর শহরে অবস্থিত। বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলি খানের নাম অনুসারে মুর্শিদাবাদ শহর এবং জেলার নামকরণ হয়েছে। এই জেলার উত্তরে মালদহ জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা, উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা, দক্ষিণে নদীয়া জেলা, দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্ব বর্ধমান জেলা, পশ্চিমে বীরভূম জেলা এবং উত্তর-পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের পাকুড় জেলা অবস্থিত। বহরমপুর মুর্শিদাবাদ কান্দি ফারাক্কা।
পর্যটন শিল্প হিসেবে মুর্শিদাবাদ: মুর্শিদাবাদ অতীতে বাংলার রাজধানী ছিল, তাই আজো বহু ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য রয়েছে।
১) হাজারদুয়ারি প্রাসাদ:
শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। একটি সাধারণ ভুল ধারণা যে এই প্রাসাদ নবাব সিরাজউদ্দৌলা নির্মাণ করান, যদিও এই প্রাসাদের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮২৯ সালে, এবং নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় ১৮৩৭ সালে, সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর ৮০ বছর পরে, অতএব সিরাজউদ্দৌলার সাথে এই প্রাসাদের সরাসরি কোনো সম্পর্কই নেই। নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহের আদেশানুসারে ডানকান ম্যাকলয়েডের তত্ত্বাবধানে এই প্রাসাদ নির্মিত হয়। হাজার দুয়ার সমন্বিত, তাই নাম হাজার দুয়ারি, যদিও এই হাজার দুয়ারের কিছু দুয়ার নকল, দেয়ালের গায়ে দরজার অনুকরণে ছবি আঁকা। বর্তমানে এই প্রাসাদটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। টিকিট কেটে (ভারতীয়দের জন্য ৫ টাকা, এবং না-ভারতীয়দের জন্য ২০০ টাকা) আপনি ভিতরে যেতে পারেন। জাদুঘরের বাইরে সরকারি অনুমতিপ্রাপ্ত গাইড থাকবে, যারা টাকার বিনিময়ে আপনাকে হাজারদুয়ারি প্রাসাদের ইতিহাস বুঝিয়ে দেবে। মনে রাখবেন, সরকারি আদেশানুসারে এই গাইডরা জাদুঘরের ভিতরে যেতে পারেন না, অতএব আপনাকে এরা জাদুঘরের বাইরে থেকেই ইতিহাস এবং দর্শনীয়র বর্ণনা দেবেন। হাজারদুয়ারি প্রাসাদ ভালোভাবে দেখতে কমপক্ষে ৪ ঘণ্টা সময় লাগবে।
২) খোশবাগ:
হাজারদুয়ারির নিকটেই ভাগীরথী নদীতে বোটে চড়ে আপনি খোশবাগে যেতে পারেন। খোশবাগে আলিবর্দি খান, সিরাজ, সিরাজপত্নী লুৎফউন্নিসা, এবং সিরাজের পরিবার পরিজনের কবর রয়েছে।
৩) বড়া ইমামবরা:
হাজারদুয়ারি প্রাসাদের অপর পাশেই এইটি একটি মুসলমান ধর্মস্থান, মূলতঃ শিয়া মুসলমানদের জন্য। এই ইমামবরার দৈর্ঘ্য ৬৮০ ফুট। মহরমের সময় এখানে প্রচুর জনসমাগম এবং পরব পালন হয়। যদিও মুসলমান ধর্মস্থান, মহরমের সময়ে এই স্থান সকল ধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। বছরের অন্যান্য সময়ে এই ইমামবড়া বন্ধ থাকে, ফলে আপনি শুধু বাইরে থেকেই দেখতে পারেন।

৪) কাটরা মসজিদ:
নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ ১৭২৩ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করান। এই মসজিদের কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়েছে, তবে সরকার এই স্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করছে। এই মসজিদের ৫টি গম্বুজ ছিল, কিন্তু ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে দুইটি গম্বুজ ভেঙ্গে পড়ে। এই মসজিদে একসময়ে একসাথে ২,০০০ ব্যাক্তি প্রার্থনা করতে পারেন। কাটরা মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আগে একটি তোপখানা ছিল। এই স্থানে এখনো জাহান কোষা (জাহান কোষা শব্দের অর্থ বিশ্বের ধ্বংসকারী) নামে একটি বড় কামান আছে। জনশ্রুতি অনুসারে মুর্শিদ কুলি ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তরের সময় এই কামানটি সঙ্গে নিয়ে আসেন।
৫)মোতিঝিল:
এইটি একটি ঝিল এবং তৎসনলগ্ন বাগান যা সিরাজের মাসি ঘসেটি বেগমের পতি নওয়াজেশ মহম্মদ নির্মাণ করান। এই স্থান কোম্পানি বাগ নামেও পরিচিত। এই ঝিলটি দেখতে ঘোড়ান নালের মত। এর তৎসংলগ্ন স্থানে রবার্ট ক্লাইভ সুবে বাংলার (বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা) দেওয়ানিপ্রাপ্তি উদযাপন করেন (যদিও সেই উদযাপনস্থান এখন ধংসপ্রাপ্ত হয়েছে)। এই মোতিঝিলের প্রাসাদে ওয়ারেন হেস্টিংস কিছুদিন বসবাস করেন। বর্তমানে পশ্চিম্বং সরকার মোটিঝিলের কাছেই একটি উদ্যান তৈরি করেছেন, এই স্থানের আলোকশোভা আপনি সন্ধ্যাবেলা দেখতে পারেন।
৬)নাসিপুর প্রাসাদ:
রাজা কীর্তিচন্দ্র বাহাদুর ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এই প্রাসাদ নির্মাণ করান। প্রাসাদের উদ্যানে রাম ও লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির রয়েছে। কাছেই মোহনদাসের আশ্রম এবং জাফরগঞ্জ দেউড়ি রয়েছে। জগৎ শেঠের কুঠি এই স্থানের সন্নিকটেই।
কাঠগোলা বা কাঠগোলা বাগানবাড়ী: রাজা ধনপত সিং দুগর এবং রাজা লক্ষ্মীপৎ সিং দুগরের বাগানবাড়ী শতাব্দীপ্রাচীন। এখানকার আদিনাথ মন্দিরটি ১৮৭৩ সালে হেরেক চাঁদ নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের দেওয়ালের কারুকার্য অতি সুন্দর।
৭)কাশিমবাজার রাজবাড়ী:
এইটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত একটি রাজবাড়ী। পলাশীপ্রান্তর – পলাশীর যুদ্ধের স্মৃতিনিয়ে পলাশীর প্রান্তর।
৮) মুশিদাবাদের আরেকটি সম্পদের কথা না বললে কোনো কিছু অসম্পূর্ণ থেকে যাবে সেটি হল ফারাক্বা ব্যারেজ। ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত একটি বাঁধ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়। ফারাক্কা বাঁধ ২,২৪০ মিটার (৭,৩৫০ ফু) লম্বা যেটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় বানানো হয়েছিল। বাঁধ থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদী পর্যন্ত ফিডার খালটির দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল (৪০ কিমি)
