সমুদ্রতল থেকে ৫,০০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতায় হিমালয়ের কোলে উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় ওয়ান গ্রামে অবস্থিত রূপকুণ্ড হ্রদ। যাকে ‘Mystery Lake’ বা ‘রহস্য হ্রদ’ও বলা হয়। হ্রদ ঘিরে জনশ্রুতি ছিল যে এখানে নাকি মানুষের হাড়গোড় দেখা যায়। তবে যাঁরা ট্রেকিং করেন বা করতে ভালবাসেন, তাঁদের কাছে এই হ্রদের নাম অচেনা নয়। উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার প্রত্যন্ত প্রান্তে থাকা ত্রিশুল (৭১২০ মি) ও নন্দাঘুটি (৬৩১০ মি) বেসক্যাম্পের কাছেই, হিমালয়ের কোলে লুকিয়ে আছে আছে দুই মিটার গভীর এক রহস্যময় হ্রদ রূপকুণ্ড। হ্রদটির উত্তরে আছে জুনারগলি কল। ৪০০ মিটার চড়াই ডিঙিয়ে পথ চলেছে হোমকুণ্ড হয়ে রন্টি স্যাডলের দিকে। রূপকুণ্ডের পূর্বে আছে চন্দনিয়া কোট।
রূপকুণ্ড তার বুকে হাজার বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছে এক রহস্য। আপাত দৃষ্টিতে সৌন্দর্যবিহীন হয়েও বিশ্বের বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ ও অভিযাত্রীদের কাছে আজও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু রূপকুণ্ড।
কথিত আছে মহাদেব তৈরি করেছিলেন রূপকুণ্ড:
উত্তরাখণ্ডের লোকগাথা তাই বলে। বহুকাল আগে বর্তমান উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার নৌটি গ্রামে বাস করতেন নন্দাদেবী। তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল স্বয়ং মহাদেবের। রীতি অনুযায়ী তাঁকে স্বামীর বাড়ি হোমকুণ্ড যেতে হয়েছিল। শোভাযাত্রা সহকারে নন্দাদেবীকে যখন তাঁর স্বামীর কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন হঠাৎ নন্দাদেবীর তৃষ্ণা পায়। ত্রিসীমানায় কোনও জলের উৎস ছিল না। তৃষ্ণার্ত নন্দাদেবী তখন মহাদেবকে স্মরণ করেন।
দৈববলে মহাদেব তাঁর তৃষ্ণার্ত স্ত্রীর জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন এক ছোট্ট হ্রদ বেদিনি কুণ্ড। নন্দাদেবী ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা সবাই বেদিনি কুণ্ডের জল পান করেছিলেন। এরপর আবার এগিয়ে চলেছিল শোভাযাত্রা। স্ত্রীর আবার জল পিপাসা পেতে পারে ভেবে মহাদেব যাত্রাপথে তৈরি করে দিয়েছিলেন আরেকটি হ্রদ। এটিই হল রূপকুণ্ড।
কথিত আছে মহাদেব তৈরি করেছিলেন রূপকুণ্ড:
উত্তরাখণ্ডের লোকগাথা তাই বলে। বহুকাল আগে বর্তমান উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার নৌটি গ্রামে বাস করতেন নন্দাদেবী। তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল স্বয়ং মহাদেবের। রীতি অনুযায়ী তাঁকে স্বামীর বাড়ি হোমকুণ্ড যেতে হয়েছিল। শোভাযাত্রা সহকারে নন্দাদেবীকে যখন তাঁর স্বামীর কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন হঠাৎ নন্দাদেবীর তৃষ্ণা পায়। ত্রিসীমানায় কোনও জলের উৎস ছিল না। তৃষ্ণার্ত নন্দাদেবী তখন মহাদেবকে স্মরণ করেন।
দৈববলে মহাদেব তাঁর তৃষ্ণার্ত স্ত্রীর জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন এক ছোট্ট হ্রদ বেদিনি কুণ্ড। নন্দাদেবী ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা সবাই বেদিনি কুণ্ডের জল পান করেছিলেন। এরপর আবার এগিয়ে চলেছিল শোভাযাত্রা। স্ত্রীর আবার জল পিপাসা পেতে পারে ভেবে মহাদেব যাত্রাপথে তৈরি করে দিয়েছিলেন আরেকটি হ্রদ। এটিই হল রূপকুণ্ড।
যেভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল রূপকুণ্ড:
১৯৪২ সালের গ্রীষ্মকাল,হিমবাহের বরফ সেবার একটু বেশিই গলে গিয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতের ফরেস্ট অফিসার হরি কৃষণ মাধওয়াল ও তাঁর দল, ১৬৪৭০ ফুট উচ্চতায় আবিষ্কার করেছিলেন হিমবাহের জলে পুষ্ট একটি হ্রদ। টলটলে স্বচ্ছ জলের নীচে থাকা পাথুরে ভূমি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।
কাছে গিয়ে চমকে উঠেছিলেন মাধওয়াল। জলের নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শয়ে শয়ে নরকঙ্কাল, নরকরোটি ও হাড়গোড়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঠের কারুশিল্প, লোহার তৈরি বল্লমের ডগা, চামড়ার চটি ও ধাতব রিং সহ আরও অনেক কিছু।
বিস্মিত ও কিছুটা আতঙ্কিত মাধওয়াল সাহেব বিশদভাবে সব লিখে পাঠিয়েছিলেন তাঁর উর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে। মাধওয়ালের পাঠানো রিপোর্ট পড়ে ব্রিটিশরা অনুমান করেছিল ওই কঙ্কালগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনাদের হতে পারে। জাপানি সেনারা সম্ভবত জুনারগলি গিরিপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছিল। প্রবল তুষারঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারায়।
এই তত্ত্ব মানেননি অনেকে
কারণ, হ্রদের জলে পড়ে থাকা কঙ্কালগুলি দেখে মনে হচ্ছিল সেগুলি শত শত বছরের পুরানো। কিন্তু কঙ্কালগুলি কাদের? সেগুলে হ্রদের জলে এলই বা কীভাবে? ১৯৫৬ সালে সেটা জানার প্রথম চেষ্টা চালায় হায়দরাবাদের Center for Cellular and Molecular Biology নামক সংস্থাটি। ডিএনএ টেস্টের জন্য বিজ্ঞানীরা কঙ্কালগুলি থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন।
পরীক্ষা থেকে জানা যায় কঙ্কালগুলি দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষদের। বড় কঙ্কালগুলি দীর্ঘদেহী ইরানীয় মানুষদের এবং ছোট কঙ্কালগুলি সম্ভবত স্থানীয় মানুষদের। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, কেন ইরানিরা ওই পথ দিয়ে ভারতে আসবেন? স্থানীয়রা কি তাঁদের আসতে সাহায্য করেছিলেন? ইরানিদের ভারতে আসার কারণই বা কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
তবে আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে গাড়ওয়াল কুমায়ুনের বিভিন্ন লোকগাথার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল রহস্যময় রূপকুণ্ড। রূপকুণ্ডের বরফে জমে যাওয়া মানুষগুলি কারা, তা বলে দিয়েছিল চামৌলির লোকগান ও লোকগাথা। তবে বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে লোকগাথার দেওয়া তথ্যের কোনও মিল ছিল না। থাকার কথাও নয়। কিন্তু স্থানীয় মানুষেরা সেগুলিই বিশ্বাস করেছিল।
লোকগাথা, লোকগানগুলি পরবর্তীকালে বিভিন্ন এলাকায় পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হলেও সব কাহিনির অন্যতম চরিত্র হয়ে আছেন কনৌজ রাজ যশদয়াল সিং।
কঙ্কাল ঘিরে বিজ্ঞানীদের মতামত:
১) ব্রিটিশদের বলে যাওয়া ‘জাপানি সেনা’ তত্ত্ব প্রথমেই খারিজ হয়ে গিয়েছিল। কারণ হ্রদের জলে কোনও আধুনিক অস্ত্র পাওয়া যায়নি। অস্ত্র বলতে পাওয়া গিয়েছিল বল্লমের ফলা। বল্লম দিয়ে জাপানি সেনারা নিশ্চয়ই বিশ্বযুদ্ধ লড়েনি।
২) অনেকের মতে কঙ্কালগুলি কোনও হতভাগ্য তীর্থযাত্রী দলের। চামোলির মানুষরা প্রতি ১২ বছর অন্তর অন্তর নন্দা জাত বা নন্দা রাজ জাত নামে এক তীর্থযাত্রায় যান। নন্দাদেবীর নিজের গ্রাম নৌটি থেকে যাত্রা শুরু করে তীর্থ যাত্রীরা রূপকুন্ড হোমকুণ্ড হয়ে পৌঁছান ভগবতী গ্রামে।
৩) এই তত্ত্বটিও খারিজ করলেন অনেকে। তাঁরা বললেন, নন্দা জাত-এ মহিলাদের যাওয়া নিষেধ। কিন্তু রূপকুণ্ডে মিলেছে বেশ কিছু মহিলার কঙ্কাল। তাছাড়া কুণ্ডের জলে তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে যা যা থাকার কথা সে সব কিছুই পাওয়া যায়নি।
৩) কেউ বলেছেন এঁরা হতে পারেন ব্যবসায়ীর দল। যাঁরা তিব্বত থেকে পণ্য নিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তখনকার দিনে পশুর পিঠে করে ভিনদেশ থেকে পাহাড়ি গিরিপথ ধরে বিক্রয়যোগ্য পণ্য আসত ভারতে। হ্রদের জলে থাকা মানুষের কঙ্কালের সঙ্গে কোনও জন্তুর কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই এই কঙ্কালগুলি ভিনদেশী ব্যবসায়ীদেরও নয়। তাছাড়া এই পথে ব্যবসায়ীদের আসা যাওয়া ছিল বলে কোনও রেকর্ড নেই।
৪) কারও মতে ওই অঞ্চলে ‘কিদা জড়ি’ নামে ওষুধের ক্ষমতা যুক্ত মাশরুম খুঁজতে গিয়ে শিলাবৃষ্টির কবলে পড়েছিলেন কোনও দল। যুক্তিবাদীরা বলছেন, কিন্তু প্রায় তিনশ মানুষ একসঙ্গে মাশরুম খুঁজতে যাবেন ?
৫) কেউ বলেছেন হত্যভাগ্য মানুষগুলি হয়তো নরবলীর মতো ধর্মীয় কোনও ভয়ঙ্কর উৎসর্গ প্রথার শিকার। যুক্তিবাদীরা বলছেন তা হলেও সেটাও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকার কথা ছিল।
৬) কেউ বলেছেন কঙ্কালগুলি ফিরোজ শাহ তুঘলকের হারিয়ে যাওয়া সৈন্যদলের। কিন্তু এই যুক্তির সপক্ষে মেলেনি কোনও প্রমাণ।
৭) কেউ বলেন কঙ্কালগুলি ডোগরাদের সেনাধক্ষ্য জোরাওয়ার সিং ও তাঁর সৈন্যদলের। ১৮৪১ সালের মে মাস থেকে ১৮৪২ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত চলেছিল ডোগরা- তিব্বতিদের মধ্যে যুদ্ধ। জোরাওয়ার সিং-এর তত্ত্ব খারিজ হয়ে গিয়েছিল, কারণ ইতিহাস বলছে তিব্বতিদের সঙ্গে মিসসারের যুদ্ধে তিনি প্রাণ হারান। এই পথে তাঁর আসার কোনও সম্ভবনাই ছিল না।।