Attention Disorder Hyperactive. ADHD একটি স্নায়বিক রোগ, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার বলা হয়ে থাকে। ADHD-তে অাক্রান্ত হলে শিশুরা খুবই অমনোযোগী, ক্ষিপ্ত, আক্রমণকারী ও অতিমাত্রায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। তারা পড়াশোনা করতে চায় না এবং নিজের ইচ্ছামতো চলতে ভালবাসে।
ইতিহাস
১৯০২ সালে ইংরেজ চিকিৎসাবিদ স্যার জর্জ স্টিল সর্বপ্রথম এ রোগ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা প্রদান করেন। তিনি এই রোগকে শিশুর নৈতিক বিচারজনিত বিকার হিসেবে অভিহিত করেন। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এ রোগের নাম ছিল হাইপারকাইনেটিক ইম্পালস ডিজঅর্ডার। ১৯৮০ সালে রোগটি ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট ডিজঅর্ডার’ নামে অ্যামেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের তৈরি করা মানসিক রোগের শ্রেণীবিন্যাস এর ২য় সংস্করণে (DSM-II) স্থান পায়। ১৯৮৭ সালে বিজ্ঞানীরা DSM-III এ রোগটির নামের সাথে ‘হাইপার অ্যাক্টিভিটি’ শব্দদ্বয় যুক্ত করেন এবং তিন ধরনের উপসর্গের কথা উল্লেখ করেন। ২০০০ সালে রোগটির তিনটি প্রকরণ আবিষ্কৃত হয় ও তা DSM-IV এ স্থান পায়।
শ্রেণীকরণ
সাধারণত শিশুদের তিন ধরনের ADHD হয়ে থাকে।
(১) আবেগপ্রবণ ADHD
(২) অমনোযোগী ADHD ও
(৩) মিশ্র ADHD
কারণ
ADHD-তে অাক্রান্ত হওয়ার পেছনে কিছু কারণ কাজ করে। এগুলো হলো-
জিনগত কারণ: বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, ৮০ শতাংশ রোগীর এই সমস্যা তাদের জেনেটিক কাঠামোর থেকে উৎপন্ন হয়েছে।
পরিবেশগত কারণ: দেখা গেছে, যদি কোনো গর্ভবতী মহিলা সিগারেট বা মদ্যপান করেন, সেক্ষেত্রে তাদের শিশুদের ADHD সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
মানসিক কারণ: এ কথাও প্রমাণিত হয়েছে যে, যদি দীর্ঘদিন ধরে শিশুরা কোনো কারণে অযত্নের সম্মুখীন হতে বাধ্য হয়, তাহলে তাদের মধ্যে ADHD সমস্যা উৎপন্ন হয়।
ব্যবহারগত কারণ: কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শিশুদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও মানসিক যাতনার কারণেও শিশুদের মধ্যে ADHD সমস্যা উৎপন্ন হয়।
উপসর্গ
ADHD এর উপসর্গগুলোকে প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
১. অমনোযোগিতা
★ গভীর মনোযোগ না দেওয়ায় প্রায়ই ভুল করা বা বিস্তৃত বিষয় বুঝতে অসমর্থ হওয়া।
★ ধারাবাহিক নির্দেশনা বা কার্যক্রম অনুসরণ করতে না পারা।
★ চারপাশে হওয়া ঘটনা ভুলে যাওয়া।
★ বারবার একটি জিনিস পড়েও লেখা বা বলার সময় ভুল করা।
★ সামান্য শব্দ বা গোলমালেই মনোযোগ ভিন্ন দিকে আকৃষ্ট হওয়া।
★ অধিক মনোযোগ প্রয়োজন এমন কাজ এড়িয়ে যাওয়া।
★ গাণিতিক সমস্যা ধাপে ধাপে করতে না পারা।
★ জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলা।
★ ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখতে না পেরে পাঠদানকালে সহপাঠীর সাথে কথা বলা।
২. অতিচাঞ্চল্য
★ নির্দিষ্ট জায়গায় বসে থাকতে অস্বস্তিবোধ।
★ নীরবতা বজায় রাখা প্রয়োজন এমন পরিবেশেও প্রচুর চিৎকার-চেঁচামেচি করে সবাইকে বিরক্ত করা।
★ পরিণামের কথা চিন্তা না করেই কাজ করে ফেলা।
★ খারাপ অভিজ্ঞতা বা ভুল থেকে শিক্ষালাভ না করা।
★ কোনো খেলার নিয়মকানুন পড়ায় সময় না দিয়েই অংশগ্রহণের জন্য তাড়াহুড়া করা।
৩. অাবেগপ্রবণতা
★ ঝোঁকের বশবর্তী হয়ে কাজ করা।
★ কোনো কিছু করার কথা ভাবলেই তা করতে ঝাঁপিয়ে পড়া।
★ একটি কাজ সম্পূর্ণ না করেই অন্য কাজ শুরু করে দেয়া।
★ প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই উত্তর দেয়া।
★ ধৈর্য্যের অভাবে তড়িঘড়ি করে কোনো কিছু করতে গিয়ে ভুল করে ফেলা।
★ অন্যের কথার মাঝে ঢুকে পড়া।
★ খেলাধুলায় ব্যস্ত অন্য শিশুদের মাঝে জোর করে ঢুকে পড়া, অথচ সেখানে সে হয়ত কাঙ্খিত নয়।
রোগনির্ণয়
কোনো শিশু ADHD আক্রান্ত কি না, সে ব্যাপারে একমাত্র মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাই বিভিন্ন লক্ষণ দেখে বলতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে এই রোগের মূল্যায়ন করে থাকেন। এমনকি পরীক্ষার মাধ্যমে তারা এটাও দেখে নেন যে শিশুটি অন্য কোনো রোগ বা বিকারে আক্রান্ত কি না। এক্ষেত্রে কিছু পরীক্ষা হলো
১) কনার্স’ প্যারেন্ট রেটিং স্কেল
২) ডেনভার ডেভেলপমেন্ট স্ক্রিনিং টেস্ট
৩) চাইল্ড বিহেভিয়ার চেকলিস্ট
জটিলতা
টওরেট সিনড্রোম: এ সমস্যায় শরীরের বিশেষত মুখের মাংসপেশি অনিচ্ছাসত্ত্বেও নড়ে। যার ফলে ভেংচি দেওয়া, চোখ পিটপিট করা, একই কথা বার বার বলার মতো সমস্যা হতে পারে।
অপজিশনাল ডেফিয়েন্ট ডিজঅর্ডার: ADHD আক্রান্তদের প্রায় ৫০% এর ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি দেখা যায়। এই সমস্যায় শিশু অতিরিক্ত সংবেদনশীল, প্রতিক্রিয়াশীল, অল্পতেই উত্তেজিত ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে।
কনডাক্ট ডিজঅর্ডার: ADHD আক্রান্তদের প্রায় ২০% এর ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি দেখা যায়। এক্ষেত্রে শিশু বদরাগী, একগুঁয়ে, আক্রমণাত্মক স্বভাবের হয়ে থাকে। বেয়াদবি করা, মিথ্যা কথা বলা, এমনকি চুরি করার মতো সমস্যাও দেখা যেতে পারে।
উল্লেখ, ADHD আক্রান্তদের মধ্যে যারা ODD বা CD সমস্যায় ভোগে, তাদের প্রায় ৫০% বড় হয়ে অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার নামক অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে দেখা যায়।
স্লাগিশ কগনিটিভ টেম্পো: ADHD আক্রান্তদের প্রায় ৩০%- ৫০% ক্ষেত্রে স্লাগিশ কগনিটিভ টেম্পো (SCT) নামক আরেক সমস্যা দেখা যায়। এতে যেসব উপসর্গ দেখা যায় তা হলো অতিরিক্ত দিবাস্বপ্ন দেখা, নিজের চিন্তার জগতে হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
চিকিৎসা:-
কাউন্সেলিং/সাইকোথেরাপি: বিশ্বব্যাপি এ রোগের চিকিৎসায় রোগী ও রোগীর অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। প্যারেন্ট কাউন্সেলিং, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (সিবিটি), নিউরো ফিডব্যাক ব্রেন ট্রেনিং সহ বিভিন্ন সাইকোথেরাপির মূল লক্ষ্য হলো –
* মনোযোগের ঘাটতি দূর করা।
* অতিরিক্ত চঞ্চলতা হ্রাস করা।
* লেখাপড়া তথা একাডেমিক পারফর্মেন্স বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
* বলা ও লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি।
* রাগ ও আক্রমণাত্মক আচরণ নিয়ন্ত্রণ।
* নিজের কাজ নিজে করার সক্ষমতা বৃদ্ধি।
* সম্পর্ক তৈরি এবং সম্পর্ক ধরে রাখা ও উন্নয়নে সক্ষমতা বৃদ্ধি।
* পরিবার ও সমাজে ADHD আক্রান্ত শিশুর জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করা।
এই চিকিৎসায় শিক্ষক এবং অভিভাবকদের বিশাল ভূমিকা থাকে। অভিভাবক এবং শিক্ষকদের শেখানো হয় কীভাবে তারা শিশুদের নিয়ন্ত্রণে রেখে শিক্ষা দেবেন। অভিভাবক এবং শিক্ষকরা যদি এই ট্রেনিং নিয়ে বাচ্চাদের “ইতিবাচক” চিন্তাধারায় এগিয়ে নিয়ে সমাজের মূল স্রোতে চলার জন্য বিশেষ যত্ন নিয়ে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে থাকেন, তাহলে অবশ্যই শিশুরা এই সমস্যা কাটিয়ে উঠবে।