বোধহয় একেই বলে ঠাকুরের ইচ্ছে। এমনই তাঁর মাহাত্ম্য। আজ যে বিস্তৃত ভূখণ্ডে বিশ্ববিখ্যাত বেলুড় মঠ, তারই অন্তত একাংশে একসময় চরণচিহ্ন এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং। স্বামী বিবেকানন্দ মঠের জন্য ওই জমি কিনেছিলেন বিহারী ভদ্রলোক বাবু ভাগবৎনারায়ণ সিংয়ের কাছ থেকে। ছোট দুটি বাড়িসমেত ২২ বিঘা। ১৮৯৮ সালের ৪ মার্চ। তবে স্বামীজির জানা ছিল না যে, তারও আগে ওই জমিতেই ছিল ঠাকুরের গৃহী ভক্ত ‘কাপ্তেন’ বিশ্বনাথ উপাধ্যায়ের কাঠগোলা। সেখানেই একদা পদধূলি দিয়েছিলেন ঠাকুর। আমরা জানি, ঠাকুর মর্তলীলা সংরবণ করেন ১৮৮৬ সালের ১৬ আগস্ট। অর্থাৎ বেলুড়ে ওই জমি কেনার অনেক আগেই ঠাকুর সেখানে গিয়েছিলেন। যেন স্থায়ী মঠ স্থাপনের উদ্দেশ্যেই সেখানে ‘কুটোবাঁধা’ হয়ে গিয়েছিল। স্থায়ী মঠের জন্য অন্যত্র জমি সংগ্রহের সকল চেষ্টাই শেষাবধি ব্যর্থ হয়েছিল। এই ঘটনাকে দৈবনির্ধারিত ছাড়া কীইবা বলা যায়। বিশ্বনাথ উপাধ্যায় ছিলেন নেপালের রাজার ভারতে নিযুক্ত উকিল। রাজপ্রতিনিধিরূপেই তিনি কলকাতায় বাস করতেন। বেলুড়ে নেপালরাজের একটি কাঠগোলা ছিল। প্রথম দিকে বিশ্বনাথ উপাধ্যায় ওই কাঠগোলাতেই কর্মচারী নিযুক্ত হন। তখন শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভমাত্রই তিনি ঠাকুরের পরম ভক্ত হয়ে ওঠেন। ঠাকুর তাঁকে আদর করে ‘কাপ্তেন’ ডাকতেন। কাপ্তেনের অনুরোধেই ঠাকুর বেলুড়ের ওই কাঠগোলা ঘুরতে যান। ওই স্থান মাহাত্ম্য সম্পর্কে স্বামী গম্ভীরানন্দ এক স্থানে সারদা দেবীর মুখে বলেছিলেন, ‘‘আমি কিন্তু বরাবরই দেখতুম, ঠাকুর যেন গঙ্গার ওপরে এই জায়গাটিতে—যেখানে এখন (বেলুড়) মঠ, কলাবাগান-টাগান—তার মধ্যে ঘর, সেখানে বাস করছেন।’’ জমিটি সংগ্রহের পর শ্রীমা আরও বলেছিলেন, জমিটা ঠাকুরের ইচ্ছাতেই হল। মঠের জন্য জমিটা তিনিই নির্বাচন করে গিয়েছিলেন! বেলুড়ে জমি তো কেনা হল। কিন্তু তা অসমতল। অতএব সেখানে মঠ নির্মাণ করতে একটু সময় লাগবে, তার তদারকিও দরকার। অতএব বেলুড়েই কাছাকাছি নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়ি ভাড়া নেওয়া হল। মঠ অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হল সেখানেই। বারাণসীর সমতুল গঙ্গার পশ্চিম তীরের এই বাড়িতেই শ্রীমা বসবাস করার সময় ছোট ছাদে পঞ্চতপা ব্রত করেছিলেন। সদ্য-কেনা কাপ্তেনের কাঠগোলার মঠভূমিতে ঠাকুরকে স্বামীজি প্রতিষ্ঠা করেন এই বাড়ি থেকেই। ১৮৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর স্বামীজি নতুন মঠের জমিতে শ্রীরামকৃষ্ণের ‘আত্মারাম’কে পুজো করে পায়েস নিবেদন করেন। আর সকাতরে প্রার্থনা করেন, ঠাকুর তুমি ‘বহুজনহিতায়’ এখানে স্থির হয়ে থেকো।
বেলুড় মঠে দাঁড়িয়ে গুরুভাইদের বিবেকানন্দ সেদিনই বলেছিলেন, “কাশীপুরে ঠাকুর আমায় বলেছিলেন, ‘তুই কাঁধে করে আমায় যেখানে নিয়ে যাবি, আমি সেখানেই যাব ও থাকব। তা গাছতলায় কি, আর কুটিরই কি।’ সেজন্যই আমি স্বয়ং তাঁকে কাঁধে করে নতুন মঠভূমিতে নিয়ে যাচ্ছি। নিশ্চয় জানবি, বহুকাল পর্যন্ত ‘বহুজনহিতায়’ ঠাকুর ওই স্থানে স্থির হয়ে থাকবেন। প্রত্যেক ভক্ত ঠাকুরকে আপন বুদ্ধির রঙে রাঙিয়ে এক-এক জনে এক-এক রকম দেখে ও বোঝে। তিনি যেন মহাসূর্য, আর আমরা যেন প্রত্যেকে এক-এক রকম রঙিন কাচ চোখে দিয়ে সেই একই সূর্যকে নানা রং-বিশিষ্ট বলে দেখছি। এটি ঠিক সেই ভাবের কেন্দ্রস্থান হবে। এখান থেকে যে মহাসমন্বয়ের উদ্ভিন্ন ছটা বেরবে তাতে জগৎ প্লাবিত হয়ে যাবে। ঠাকুরের ইচ্ছেয় আজ তাঁর ধর্মক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা হল। বারো বছরের চিন্তা আমার মাথা থেকে নামল। আমার মনে এখন কী হচ্ছে জানিস? এই মঠ হবে বিদ্যা ও সাধনার কেন্দ্রস্থান। … সময়ে সব হবে। আমি তো পত্তন-মাত্র করে দিচ্ছি। এর পর আরও কত কী হবে !” জীবনের উপান্তে এসে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমি যে নিষ্কর্মা সাধু হয়ে থাকিনি, সে বিষয়ে অন্তর থেকে আমি নিঃসন্দেহ। প্রাণ ঢেলে খেটেছি। আমার কাজের মধ্যে সত্যের বীজ যদি কিছু থাকে, কালে তা অঙ্কুরিত হবেই।” শ্রীশ্রীমাও এই মঠভূমি দেখতে এসেছিলেন। তাই পরে তিনি বলেছিলেন, অত্যন্ত শান্ত জায়গা বেলুড়ে তিনি খুব ভালো ছিলেন। তাঁর ধ্যান লেগেই থাকত। তাই ওখানে একটি ‘স্থান’ করতে নরেনের ইচ্ছে হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ নির্দেশিত পথে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ গঠন করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৮৬ সালে। অর্থাৎ ঠাকুর যে-বছর দেহসংবরণ করলেন সে-বছরই। বরাহনগরের এক জীর্ণ বাড়িতে। যা ‘বরাহনগর মঠ’ নামে রামকৃষ্ণ-সাম্রাজ্যে সুপরিচিত। সুদীর্ঘ ৩৪ বছর এই রামকৃষ্ণ সঙ্ঘকে লালিত ও পালিত করেছেন সঙ্ঘজননী সারদা দেবী। সেই রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের বাস্তব রূপ দিলেন স্বামী বিবেকানন্দ বাগবাজারে বলরাম মন্দিরে ১৮৯৭ সালের ১ মে। নাম হল রামকৃষ্ণ মিশন। আর বরাহনগর মঠ রূপান্তরিত হল ‘রামকৃষ্ণ মঠ’-এ। এই বরানগরে থাকতেই বিবেকানন্দের মন ঠিক করে নিয়েছিল স্থায়ী মঠ ঠিক কোথায় হবে। বরাহনগর খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে তিনি একদিন গুরুভাইদের বলেছিলেন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে গঙ্গার ওপারে কাছেপিঠেই আমাদের স্থায়ী মঠটি হতে চলেছে। বেলুড় মঠের জমি কেনার পর স্বামীজি সওয়া চার বছর জীবিত ছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই তিনি মঠ প্রতিষ্ঠার মূল কাজগুলি সাঙ্গ করে গিয়েছিলেন। মিশন তৈরির পর তার কলকাতা কেন্দ্রের ভার দেওয়া হয়েছিল স্বামী ব্রহ্মানন্দকে। অন্যদিকে, ১৮৯৮ সালে বেলুড়ে নতুন মঠ নির্মাণের কাজ শুরু হলে তার দায়-দায়িত্বও ব্রহ্মানন্দের৷ বোধহয় একেই বলে ঠাকুরের ইচ্ছে। এমনই তাঁর মাহাত্ম্য। আজ যে বিস্তৃত ভূখণ্ডে বিশ্ববিখ্যাত বেলুড় মঠ, তারই অন্তত একাংশে একসময় চরণচিহ্ন এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং। স্বামী বিবেকানন্দ মঠের জন্য ওই জমি কিনেছিলেন বিহারী ভদ্রলোক বাবু ভাগবৎনারায়ণ সিংয়ের কাছ থেকে। ছোট দুটি বাড়িসমেত ২২ বিঘা। ১৮৯৮ সালের ৪ মার্চ। তবে স্বামীজির জানা ছিল না যে, তারও আগে ওই জমিতেই ছিল ঠাকুরের গৃহী ভক্ত ‘কাপ্তেন’ বিশ্বনাথ উপাধ্যায়ের কাঠগোলা। সেখানেই একদা পদধূলি দিয়েছিলেন ঠাকুর। আমরা জানি, ঠাকুর মর্তলীলা সংরবণ করেন ১৮৮৬ সালের ১৬ আগস্ট। অর্থাৎ বেলুড়ে ওই জমি কেনার অনেক আগেই ঠাকুর সেখানে গিয়েছিলেন। যেন স্থায়ী মঠ স্থাপনের উদ্দেশ্যেই সেখানে ‘কুটোবাঁধা’ হয়ে গিয়েছিল। স্থায়ী মঠের জন্য অন্যত্র জমি সংগ্রহের সকল চেষ্টাই শেষাবধি ব্যর্থ হয়েছিল। এই ঘটনাকে দৈবনির্ধারিত ছাড়া কীইবা বলা যায়। বিশ্বনাথ উপাধ্যায় ছিলেন নেপালের রাজার ভারতে নিযুক্ত উকিল। রাজপ্রতিনিধিরূপেই তিনি কলকাতায় বাস করতেন। বেলুড়ে নেপালরাজের একটি কাঠগোলা ছিল। প্রথম দিকে বিশ্বনাথ উপাধ্যায় ওই কাঠগোলাতেই কর্মচারী নিযুক্ত হন। তখন শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভমাত্রই তিনি ঠাকুরের পরম ভক্ত হয়ে ওঠেন। ঠাকুর তাঁকে আদর করে ‘কাপ্তেন’ ডাকতেন। কাপ্তেনের অনুরোধেই ঠাকুর বেলুড়ের ওই কাঠগোলা ঘুরতে যান। ওই স্থান মাহাত্ম্য সম্পর্কে স্বামী গম্ভীরানন্দ এক স্থানে সারদা দেবীর মুখে বলেছিলেন, ‘‘আমি কিন্তু বরাবরই দেখতুম, ঠাকুর যেন গঙ্গার ওপরে এই জায়গাটিতে—যেখানে এখন (বেলুড়) মঠ, কলাবাগান-টাগান—তার মধ্যে ঘর, সেখানে বাস করছেন।’’ জমিটি সংগ্রহের পর শ্রীমা আরও বলেছিলেন, জমিটা ঠাকুরের ইচ্ছাতেই হল। মঠের জন্য জমিটা তিনিই নির্বাচন করে গিয়েছিলেন! বেলুড়ে জমি তো কেনা হল। কিন্তু তা অসমতল। অতএব সেখানে মঠ নির্মাণ করতে একটু সময় লাগবে, তার তদারকিও দরকার। অতএব বেলুড়েই কাছাকাছি নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়ি ভাড়া নেওয়া হল। মঠ অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হল সেখানেই। বারাণসীর সমতুল গঙ্গার পশ্চিম তীরের এই বাড়িতেই শ্রীমা বসবাস করার সময় ছোট ছাদে পঞ্চতপা ব্রত করেছিলেন। সদ্য-কেনা কাপ্তেনের কাঠগোলার মঠভূমিতে ঠাকুরকে স্বামীজি প্রতিষ্ঠা করেন এই বাড়ি থেকেই। ১৮৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর স্বামীজি নতুন মঠের জমিতে শ্রীরামকৃষ্ণের ‘আত্মারাম’কে পুজো করে পায়েস নিবেদন করেন। আর সকাতরে প্রার্থনা করেন, ঠাকুর তুমি ‘বহুজনহিতায়’ এখানে স্থির হয়ে থেকো। বেলুড় মঠে দাঁড়িয়ে গুরুভাইদের বিবেকানন্দ সেদিনই বলেছিলেন, “কাশীপুরে ঠাকুর আমায় বলেছিলেন, ‘তুই কাঁধে করে আমায় যেখানে নিয়ে যাবি, আমি সেখানেই যাব ও থাকব। তা গাছতলায় কি, আর কুটিরই কি।’ সেজন্যই আমি স্বয়ং তাঁকে কাঁধে করে নতুন মঠভূমিতে নিয়ে যাচ্ছি। নিশ্চয় জানবি, বহুকাল পর্যন্ত ‘বহুজনহিতায়’ ঠাকুর ওই স্থানে স্থির হয়ে থাকবেন। প্রত্যেক ভক্ত ঠাকুরকে আপন বুদ্ধির রঙে রাঙিয়ে এক-এক জনে এক-এক রকম দেখে ও বোঝে। তিনি যেন মহাসূর্য, আর আমরা যেন প্রত্যেকে এক-এক রকম রঙিন কাচ চোখে দিয়ে সেই একই সূর্যকে নানা রং-বিশিষ্ট বলে দেখছি। এটি ঠিক সেই ভাবের কেন্দ্রস্থান হবে। এখান থেকে যে মহাসমন্বয়ের উদ্ভিন্ন ছটা বেরবে তাতে জগৎ প্লাবিত হয়ে যাবে। ঠাকুরের ইচ্ছেয় আজ তাঁর ধর্মক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা হল। বারো বছরের চিন্তা আমার মাথা থেকে নামল। আমার মনে এখন কী হচ্ছে জানিস? এই মঠ হবে বিদ্যা ও সাধনার কেন্দ্রস্থান। … সময়ে সব হবে। আমি তো পত্তন-মাত্র করে দিচ্ছি। এর পর আরও কত কী হবে !” জীবনের উপান্তে এসে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমি যে নিষ্কর্মা সাধু হয়ে থাকিনি, সে বিষয়ে অন্তর থেকে আমি নিঃসন্দেহ। প্রাণ ঢেলে খেটেছি। আমার কাজের মধ্যে সত্যের বীজ যদি কিছু থাকে, কালে তা অঙ্কুরিত হবেই।” শ্রীশ্রীমাও এই মঠভূমি দেখতে এসেছিলেন। তাই পরে তিনি বলেছিলেন, অত্যন্ত শান্ত জায়গা বেলুড়ে তিনি খুব ভালো ছিলেন। তাঁর ধ্যান লেগেই থাকত। তাই ওখানে একটি ‘স্থান’ করতে নরেনের ইচ্ছে হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ নির্দেশিত পথে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ গঠন করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৮৬ সালে। অর্থাৎ ঠাকুর যে-বছর দেহসংবরণ করলেন সে-বছরই। বরাহনগরের এক জীর্ণ বাড়িতে। যা ‘বরাহনগর মঠ’ নামে রামকৃষ্ণ-সাম্রাজ্যে সুপরিচিত। সুদীর্ঘ ৩৪ বছর এই রামকৃষ্ণ সঙ্ঘকে লালিত ও পালিত করেছেন সঙ্ঘজননী সারদা দেবী। সেই রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের বাস্তব রূপ দিলেন স্বামী বিবেকানন্দ বাগবাজারে বলরাম মন্দিরে ১৮৯৭ সালের ১ মে। নাম হল রামকৃষ্ণ মিশন। আর বরাহনগর মঠ রূপান্তরিত হল ‘রামকৃষ্ণ মঠ’-এ। এই বরানগরে থাকতেই বিবেকানন্দের মন ঠিক করে নিয়েছিল স্থায়ী মঠ ঠিক কোথায় হবে। বরাহনগর খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে তিনি একদিন গুরুভাইদের বলেছিলেন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে গঙ্গার ওপারে কাছেপিঠেই আমাদের স্থায়ী মঠটি হতে চলেছে। বেলুড় মঠের জমি কেনার পর স্বামীজি সওয়া চার বছর জীবিত ছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই তিনি মঠ প্রতিষ্ঠার মূল কাজগুলি সাঙ্গ করে গিয়েছিলেন। মিশন তৈরির পর তার কলকাতা কেন্দ্রের ভার দেওয়া হয়েছিল স্বামী ব্রহ্মানন্দকে। অন্যদিকে, ১৮৯৮ সালে বেলুড়ে নতুন মঠ নির্মাণের কাজ শুরু হলে তার দায়-দায়িত্বও ব্রহ্মানন্দের৷
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন বা ভারত বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন বা বাংলাদেশ-ভারত পাইপলাইন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তেল পরিবহনের লক্ষ্যে নির্মাণাধীন একটি পাইপলাইন। পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আনার লক্ষ্যে ২০২০ সালে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন প্রকল্পের পাইপলাইন স্থাপনের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। ১৩১.৫০ কিলোমিটার পথে পাইপলাইন স্থাপন কাজ শেষ হলে ভারতের নুলাইবাড়ী রিফাইনারি লিমিটেড থেকে সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আসবে দিনাজপুরের পার্বতীপুর তেল ডিপোতে। এতে জ্বালানি তেল সংকট দূর হবে দেশের উত্তরাঞ্চলে। পার্বতীপুর উপজেলার সোনাপুকুর নামক স্থানে এ পাইপলাইন স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করা হয়। ভারতের নুমালীগড় থেকে ১৩১.৫০ কিলোমিটার পাইপলাইনে বাংলাদেশের পার্বতীপুর ডিপোতে ডিজেল আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গত ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এরপর ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি জানান, এ ১৩১.৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ভারতের অংশে পাঁচ এবং বাংলাদেশের অংশে দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত ১২৬.৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হবে। এ প্রকল্পে ভারত ৩৪৬ কোটি রুপি ও বাংলাদেশ ৩০৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা ব্যয় করবে। আগামী ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ায় ভারত থেকে সরাসরি বাংলাদেশ পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানি হবে।
বছরের শুরুতে ভারত থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আসবে বাংলাদেশে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই দেশ। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন স্থাপন প্রায় ইতিমধ্যে শেষ পর্যায়ে। ভারতের শিলিগুড়িতে চলছে ডিজেল সরবরাহের প্রস্তুতি। আর বাংলাদেশের পার্বতীপুর প্রস্তুত হচ্ছে ভারত থেকে আসা ডিজেল সংরক্ষণ ও সরবরাহের কাজ। একই সঙ্গে জ্বালানি তেল সরবরাহের কমিশনিং নিয়েও কাজ করছে দুই দেশ। এই পাইপলাইন প্রকল্পের প্রাক্কলন ছিল ৫২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারত সরকার ৩০৩ কোটি টাকা দেয় এবং বাংলাদেশ সরকার বাকি অর্থ ২১৭ কোটি টাকা দেয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময়কাল ২০২০ থেকে জুন ২০২২ সাল পর্যন্ত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেন। চুক্তি স্বাক্ষরের ১৭ মাস পর ২২ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের প্রথম চালানটি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে আসে। আনুষ্ঠানিকভাবে একই বছরের মার্চের শুরুতে পাইপলাইনের কাজ শুরু হয়। ভারতের লুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড এবং বাংলাদেশের মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা যাবে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ আড়াই লাখ টনের মতো ডিজেল আমদানি করবে এবং পরের বছরগুলোতে এটি ৪ থেকে ৫ লাখ টন পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। চুক্তির অধীনে সরবরাহ শুরু হওয়ার দিন থেকে ১৫ বছরের জন্য বাংলাদেশ ডিজেল নেবে। বাংলাদেশ বর্তমানে লুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় ২ হাজার ২০০ টন ডিজেল আমদানি করে এবং বিপিসি বাংলাদেশ রেলওয়ের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের পার্বতীপুর তেল ডিপোতে জ্বালানি বহন করে এবং পরে ডিজেল গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়। উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভারত থেকে সরাসরি দিনাজপুরের পার্বতীপুরের রেলহেড তেল ডিপোতে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আনার উদ্যোগ নিয়েছে দু-দেশের সরকার। এ লক্ষ্যে ২০১৮ সালে সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । ফলে বৃহস্পতিবার পার্বতীপুরের সোনাপুকুর অংশে পাইপলাইন বসানোর কাজ শুরু হয়। পাইপলাইন ভারতের শিলিগুড়ির নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড থেকে ১৩০ কিলোমিটার ভারতের শিলিগুড়ি, বাংলাদেশের পঞ্চগড়, নীলফামারীর হয়ে পার্বতীপুরে আসবে। তেল সরবরাহ শুরু হলে উত্তরাঞ্চলের অঞ্চলের মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে তেল পাবে।
ভ্যালেরি ভ্লাদিমিরোভিচ পলিয়াকভ ছিলেন একজন সোভিয়েত এবং রাশিয়ান মহাকাশচারী। তিনি মহাকাশে দীর্ঘতম একক থাকার রেকর্ডধারী, এক ভ্রমণের সময় 14 মাসেরও বেশি সময় ধরে মীর মহাকাশ স্টেশনে অবস্থান করেছিলেন। তার সম্মিলিত মহাকাশ অভিজ্ঞতা ছিল 22 মাসেরও বেশি। 1972 সালে মহাকাশচারী হিসাবে নির্বাচিত, পলিয়াকভ 1988 সালে সয়ুজ TM-6-এ চড়ে মহাকাশে তার প্রথম ফ্লাইট করেন। তিনি TM-7-এ চড়ে 240 দিন পরে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। পলিয়াকভ 1994-1995 সালে মহাকাশে তার দ্বিতীয় ফ্লাইট সম্পন্ন করেন, সয়ুজ TM-18 তে উৎক্ষেপণ এবং TM-20-এর সাথে অবতরণ করার মধ্যে 437 দিন মহাকাশে কাটিয়েছেন, একজন ব্যক্তির দ্বারা মহাকাশে একটানা দীর্ঘতম সময় কাটানোর রেকর্ড স্থাপন করেছেন। ভ্যালেরি পলিয়াকভের মহাকাশে 437 দিনের রেকর্ড 8 জানুয়ারী, 1994 এ শুরু হয়েছিল। সোভিয়েত স্পেস স্টেশন মিরের জাহাজে থাকাকালীন, তিনি 22 মার্চ, 1995-এ পৃথিবীতে ফিরে আসার আগে 7,000 বারের বেশি পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছিলেন। তিনি একজন চিকিত্সক হিসাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং বাইরের মহাকাশে বর্ধিত সময় সহ্য করার জন্য মানবদেহের ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিলেন। এর আগে, পলিয়াকভ 1988-89 সালে একটি মিশনে মহাকাশে 288 দিন কাটিয়েছিলেন। এটি ছিল মহাকাশে তার প্রথম অভিযান। তিনি 8 মাস পর 1989 সালে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। তিনি মস্কোর ইনস্টিটিউট অফ বায়োমেডিকেল প্রবলেম-এর ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 1995 সালে মহাকাশচারী থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেওয়ার পরেও তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং একই সাথে রাশিয়ান মহাকাশচারীদের প্রত্যয়নের জন্য দায়ী কমিশনের ডেপুটি চেয়ার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি 1999 সালে SFINCSS-99 (স্পেস স্টেশনে আন্তর্জাতিক ক্রুদের ফ্লাইটের সিমুলেশন) একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার 430-দিনের ফ্লাইট মঙ্গলে দীর্ঘমেয়াদী মিশনের সময় মানবদেহ মাইক্রো-গ্রাভিটি পরিবেশে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় তা বুঝতে সাহায্য করেছিল। দীর্ঘ সময়ের মহাকাশ ফ্লাইটের সময় মানুষ সুস্থ মানসিক অবস্থা বজায় রাখতে সক্ষম কিনা তা নির্ধারণের জন্য এই মিশনের ডেটা ব্যবহার করা হয়েছে। এটি গবেষকদের এই উপসংহারে সাহায্য করেছে যে মঙ্গল গ্রহে ক্রুড মিশনগুলির মতো দীর্ঘমেয়াদী স্পেসফ্লাইটের সময় একটি স্থিতিশীল মেজাজ এবং সামগ্রিক কার্যকারিতা বজায় রাখা যেতে পারে। পলিয়াকভের মহাকাশে 678 দিনের দীর্ঘতম রেকর্ডটি 1999 সালে মহাকাশচারী সের্গেই আভদেয়েভ অতিক্রম করেছেন, যিনি 747 দিন মহাকাশে ছিলেন।
মীর মহাকাশ স্টেশন সম্পর্কে মীর স্পেস স্টেশনটি 1986 থেকে 2001 সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরে রাশিয়া দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। এটি ছিল প্রথম মডুলার স্পেস স্টেশন। 1986 থেকে 1996 পর্যন্ত একত্রিত, এই মহাকাশ স্টেশনের ভর আগের অন্য যে কোনো মহাকাশযানের চেয়ে বেশি ছিল। তার সময়ে, মীর কক্ষপথে বৃহত্তম কৃত্রিম উপগ্রহ ছিল। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনটি মীর স্পেস স্টেশনের কক্ষপথ ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার পরে সফল হয়েছিল। শোনা যায়, পৃথিবীতে ফিরে আসার পর ভ্যালেরি নিজেই মহাকাশযান (Soyuz) থেকে নেমে আসেন এবং হেঁটে নিকটবর্তী বাহনের (Transport Vehicle) কাছে পৌঁছন। এক্ষেত্রে তিনি অন্য কারো গ্রহণে অসম্মত হন। নভশ্চর ছাড়াও ভ্যালেরির আরও একটি পরিচয় ছিল। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানবশরীর মহাকাশে আরও দীর্ঘ বসবাস সহন করতে পারে। উল্লেখ্য, Roscosmos -এর ঘোষণা থেকে ভ্যালেরির মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি।
মহালয়া শব্দের অর্থ মহান আলয় অর্থাৎ মহান আশ্রয়। আবার মহালয়ার অর্থ হিসেবে পিতৃলোককে বোঝায়। এই জগতের স্বর্গতঃ পিতৃপুরুষরা যেখানে থাকেন বলে বিশ্বাস। অর্থাৎ পিতৃলোককে সশ্রদ্ধ স্মরণ করার অনুষ্ঠানই ‘মহালয়া’ নামে পরিচিত। পিতৃপক্ষের শেষ হবার পর, অমাবস্যার অবসান হলে দেবীপক্ষের শুরু হয়। সেই লগ্নটিকেই আমরা মহালয়া বলে থাকি। এই জন্য মহালয়া ‘স্ত্রীকারান্ত’। এই ত্রিভুবনে দেবী দুর্গাই হলেন মহান আশ্রয়। তার আগমনের লগ্নই ‘ মহালয়া ‘। আবার কেউ কেউ বলেন ‘ পিতৃলোক ‘ হল সেই মহান স্থান। মহালয়া হল পিতৃপূজা ও মতৃপূজার সন্ধিক্ষণ। আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের শেষ ও দেবীপক্ষের শুরুতে যে অমাবস্যা আসে, তাকেই মহালয়া বলে অভিহিত করা হয়। মহালয়ার দিন একসাথে আমরা পিতৃপূজা ও মাতৃপূজা দুই’ই করে থাকি। তাই মানব জীবনে, মানব মননে এই দিনটি এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আনে। ভারতীয় ঐতিহ্যের এ এক অপূর্ব অনুভূতি। মহালয়া থেকে দুর্গাপূজার দিন গোনা শুরু হয়ে যায়। মহালয়ার ছয় দিন পরেই আসে মহাসপ্তমী। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন। লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের অভিলাষ নিয়ে। শরতের এই পূজাকে দেবীর অকাল বোধন বলা হয়। কারণ শ্রীরামচন্দ্র পূজাটি করেছিলেন অকালে, অসময়ে। আসল দুর্গাপূজা হলো বসন্তে তাই একে বাসন্তী পূজা বলা হয়। শোনা যায় সুরথ রাজা এই আসল পূজাটি করেছিলেন বসন্ত কালে। কোন শুভ কাজ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বজসহ সমগ্র জীব জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এটাই বিশ্বাস। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। এর পোশাকি নাম ‘তর্পণ”। তর্পণ মানে সন্তুষ্ট করা। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আশায় বুক বেঁধে এমনই করেছিলেন। যুগ যুগ ধরে এই ভারতের কোটি কোটি মানুষ মহালয়ার প্রভাতে তিন গন্ডুষ জলের অঞ্জলি দিয়ে আসছেন। আর আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়ে উঠছে – ” ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যন্ত ভূবন এয়ম, আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্যন্তং তৃপ্যন্ত ” -এই মন্ত্র। যার মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে চলেছেন তাদের বিদেহী পিতৃপুরুষ এবং পূর্বপুরুষদের। পুরাণে বলা আছে মহালয়ার দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার দায়িত্ব পান। ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত কোন মানুষ বা কোন দেবতার পক্ষে মহিষাসুরকে বধ করা সম্ভব ছিল না । ফলত অসীম ক্ষমতাশালী মহীষাসুর তার ক্ষমতার দম্ভে মদমত্ত হয়ে ওঠে। একে একে দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে। অঘোষিত ভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর হয়ে ওঠার বাসনা তাকে পেয়ে বসে । ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব ত্রয়ী তখন বাধ্য হয়ে মিলিতভাবে ” মহামায়া ” র রূপে অমোঘ নারী শক্তি সৃষ্টি করলেন। দেবতাদের দান করা দশটি অস্ত্রে সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা সুসজ্জিত হয়ে উঠেন। নয় দিন ব্যাপী ঘোরতর যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করলেন। এভাবেই অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির জয় প্রতিষ্ঠা পায়। যুগের পর যুগ এই বিশ্বাস, এই ধারা বয়ে আসছে । মহালয়া যেন তারই পরিচয় বহন করে চলেছে। মহালয়া হচ্ছে সেই দিন যেদিন দেবী দুর্গা এই মর্ত্যে অবতরণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস। তিনি এসেছিলেন সমস্ত অশুভ শক্তিকে পরাজিত করতে। মহালয়া পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনা বলে মহালয়াকে দুটি গতিশীল বা চলমান উৎসবের সমাহার বা সম্মিলনও বলা যেতে পারে । হিন্দু পুরাণ মতে এই সময় পিতৃপুরুষের আত্মার স্বর্গ-প্রাপ্তির জন্য পুত্রের দ্বারা শ্রাদ্ধক্রিয়া করা আবশ্যক যাকে বাংলায় বলা হয় ‘ তর্পণ’। প্রাকভোর বা প্রাতঃকালে নদীতে পুত্র তার পিতৃপুরুষদের উদ্দ্যেশ্যে ‘পিণ্ডদান ‘ করে থাকে। আসলে তা জল ও খাদ্য প্রদানের চেষ্টা ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
দেবীপক্ষ মানে দেবীকাল। দেবী দুর্গা প্রধান পূজার সাতদিন আগেই মর্ত্যে আসেন। চারদিন ধরে চলা মহাপূজার দিনগোনা শুরু হয় মহালয়ার পূণ্যলগ্ন থেকেই। আর সমগ্র ভূভারতে পূজার ঢাকে কাঠি পড়ে যায় । হিন্দুমতে ভাদ্রের অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়কালকেই দেবীপক্ষ বলে মানা হয়। বিশ্বাস করা হয়, হিন্দুদের জন্য কোন পবিত্র কাজ করার শ্রেষ্ঠ সময নাকি এটাই। উত্তর ভারতে অমাবস্যা পরবর্তী নয়দিনকেই নবরাত্রি হিসেবে পালন করা হয়। অমাবস্যার শেষ দিনে দুর্গাপ্রতিমার চোখ অঙ্কিত করা হয়। যা ‘চক্ষুদান’ নামে পরিচিত । মহালয়া অন্য এক বর্ণনা পাওয়া যায় মহাভারতের কাহিনীতে। দাতা কর্ণের মৃত্যুর পর তার কৃত শুভকর্মের জন্য তিনি স্বর্গপ্রাপ্ত হন। সেখানে কর্ণ ক্ষুধার্ত হলে তাকে প্রচুর সোনা, রুপা দেওয়া হয়। তিনি জীবিতকালে সকলকে তাই দিয়ে আসতেন। ক্ষুধার্ত কর্ণ হতাশ হন এবং খাবার চান। যমরাজ তখন বলেন জীবিতকালে কর্ণ মানুষকে কেবল সোনা দানাই দিতেন। কিন্তু পূর্বজদের কখনো খাবার ও জল দেননি। কর্ণ নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করেন ও ক্ষমা চান। তখন যমরাজ তাকে চোদ্দ দিনের জন্য মর্ত্যে ফেরত পাঠান। কর্ণ মর্ত্যে এসে মানুষকে খাবার প্রদান করেন। পূর্বজদেরও খাদ্য উৎসর্গ করেন। মানুষের আসল প্রয়োজনটা অনুধাবন করতে পারেন। অনেকে বলেন এই চোদ্দ দিনও ‘মহালয়া’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মহালয়ার প্রভাতে বা ভোরে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় মহিষাসুরমর্দিনীর আগমনী গান। ঘরে ঘরে বেজে ওঠে ‘ জাগো তুমি জাগো ‘- এর সুর। এর মধ্যে দিয়ে মাকে যেন জাগ্রত হওয়ার করুণ আবেদন জানানো হয়। যাতে মা আবির্ভূত হয়ে এই মর্ত্যধামের সকলের ক্লেশ দূর করেন। মহালয়ায় ‘পূর্বপুরুষদের উদ্দ্যেশ্যে বছরে একবার জলদান করা হিন্দুমতে অত্যন্ত আবশ্যক হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ প্রেতলোকে একদিন আমাদের মর্ত্যের হিসেবে এক বছর কালের সমান বলে বিশ্বাস। আর পূর্বপুরুষরাও নাকি সামান্য জলেরই প্রত্যাশা করেন। এই পূণ্যলগ্নে সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী সব একে অপরের অত্যন্ত কাছাকাছি চলে আসে।’ মহালয়া যেন এক বিশ্বাস। যুগ যুগ ধরে বয়ে আসা এক অমোঘ বিশ্বাস । যা আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের ধারনাকেই প্রতিষ্ঠিত করছে। যা এই মর্ত্যে জীবিতকালেও প্রতিফলিত হয়ে থাকে । মহালয়ার তর্পণ যুগ যুগ ধরে যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। ভারতীয় সংস্কৃতির এক স্তম্ভ । ধারক এবং বাহক। এর গুরুত্ব অমলিন এবং অক্ষত যা ভাবীকালেও অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে মনে হয়।