উত্তর গোলার্ধ থেকে শরতের বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গিয়েছে। প্রকৃতিতে ক্রমশ রুক্ষ্ণতা ফুটে উঠবে কিছুদিন পরই। গাছের পাতাগুলো সবুজ রং হারিয়ে হলুদ, কমলা কিংবা লাল বর্ণ ধারণ করেছে ইতোমধ্যে। উঁচু কোনো রাস্তার বুক চিরে ছুটে চলেছে গাড়ি, রাস্তার দুই ধারে সারি সারি উঁচু পাহাড় ছাড়া আর কোনও কিছু চোখে পড়ে না। রাতের অন্ধকারে এ সব পাহাড়ের চূড়ায় ভেড়ার লোমের মতো থোকায় থোকায় সাদা তুষার জমেছে, দিনের বেলায় সূর্যের আলোর সংমিশ্রণে পাহাড়ের উপরিভাগে জমে থাকা তুষারকণা বর্ণিল আলোকচ্ছটা ছড়ায়। মাঝে মধ্যে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছুটে বেড়ায় রাশি রাশি মেঘ। আবার কখনও কখনও এসব পাহাড় থেকে জন্ম নেয় নতুন জলধারা। কল্পনা বা সিনেমায় দেখা এ দৃশ্যপট বাস্তবে চোখের সামনে ধরা দেবে, স্টেপানটস্মিদা নামক ছোট্ট অঞ্চলটি বেড়াতে গেলেই। ককেশাস পর্বতমালা তার সৌন্দর্যের সবটুকু যেন সেখানে উজাড় করে দেয়। তাই এশিয়া-ইউরোপ মহাদেশের সংযোগস্থলে প্রায় ২৭ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট দেশ জর্জিয়ার পর্যটন শিল্প অনেকাংশে দাঁড়িয়ে আছে স্টেপানটস্মিদা অঞ্চলটির ওপর ভিত্তি করেই। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থী ভিসায় মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়াতে পা রাখি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত যে কোনও দেশের ভিসা কিংবা রেসিডেন্ট পারমিট থাকলে জর্জিয়া ভ্রমণের জন্য আলাদাভাবে ভিসার প্রয়োজন হয় না, কেবল দেশটিতে প্রবেশের সময় ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্টে অ্যারাইভাল সিল দেন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট কৌচসার্ফিং এর মাধ্যমে জর্জিয়ান তরুণী টেও ছান্তুরিয়ার সঙ্গে পরিচিত হই। আমার চেয়ে এক বছরের ছোট। বেড়াতে যাওয়ার আগে কোনও স্থান সম্পর্কে ধারণা পেতে এবং একই সাথে ওই স্থানে বসবাস করা স্থানীয় অধিবাসীদের সাহচর্য পেতে আমি ‘কৌচসার্ফিং’ এর দ্বারস্থ হই। জর্জিয়া ভ্রমণের সময় টেও আমাকে বিশেষভাবে সঙ্গ দিয়েছিল। তার কাছ থেকেই স্টেপানটস্মিদা ভ্রমণের পরামর্শ পাওয়া। অবকাঠামোগত দিক থেকে জর্জিয়া বেশ পিছিয়ে, একই সাথে দেশটিতে গণপরিবহণ সেবার মান সে অর্থে আশানুরূপ নয়। তাই জর্জিয়াতে ভ্রমণ করতে চাইলে পূর্ব পরিকল্পনার পাশাপাশি ট্যুর গাইডের সাহায্য নেওয়া অত্যাবশ্যক। রাজধানী তিবিলিসির একেবারে প্রাণকেন্দ্রে পা রাখতে না রাখতেই সোনালি রঙের সেইন্ট জর্জের ভাস্কর্যের দেখা মেলে। ঘোড়ার পিঠে বসে টগবগিয়ে ছুটে চলছে স্বাধীনতাকামী এক যোদ্ধা, হাতে থাকা তরবারিটি তিনি এক ড্রাগনের মুখ বরাবর ঢুকিয়ে দিচ্ছেন এবং তার ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হচ্ছে সে-ই ড্রাগন। এ ভাস্কর্যটি যে স্থানে অবস্থিত তার নাম তাভিসুপলেবিস ময়দানি। ইংরেজিতে এ স্থানটিকে অনেক সময় ‘ফ্রিডম স্কয়ার’ নামে ডাকা হয়। তিবিলিসির অন্যান্য অংশের তুলনায় তাভিসুপলেবিস ময়দানি এলাকাটি বেশ জমজমাট। তাভিসুপলেবিস ময়দানিতে স্মার্ট ট্রাভেল জর্জিয়া নামক এক ট্রাভেল এজেন্সির অফিস দেখতে পেলাম। টেও- এর সহায়তায় এ ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্যে স্টেপানটস্মিদা ভ্রমণের পরিকল্পনা সাজাই। পুরো ট্যুর বাবদ আমাদের দুইজনকে ১৪০ জর্জিয়ান লারি বা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪ হাজার টাকার মতো খরচ করতে হয়েছিল। স্টেপানটস্মিদার পাশাপাশি জিনভালি লেইক, আনানুরি ফোরট্রেস, গুদাউড়ি এবং ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট রিভারস অব আরাগভিও তাদের ট্যুর প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরিকল্পনামাফিক পরের দিন সকালে মিনিবাসে চেপে টেও-কে সঙ্গে নিয়ে স্টেপানটস্মিদার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ছুটে পড়লাম।
মেঘলা দিন, শীত আসি আসি করছে। ঠাণ্ডা বাতাসের ধাক্কাটা ভালোভাবে টের পাচ্ছিলাম। আমাদের সফরসঙ্গী ছিলেন আরও বেশ কয়েকজন পর্যটক। তাদের মধ্যে মাত্র দুইজন ছিলেন রাশিয়ান, অন্যরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের নাগরিক। আমাদের ট্যুর গাইড ছিলেন মাঝবয়সী নারী নিনো। পুরো যাত্রাপথে তিনি আমাদের সামনে জর্জিয়ার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে নানা ধরনের বর্ণনা তুলে ধরলেন। উঁচুনিচু ও আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো আমাদের মিনিবাস। তিবিলিস থেকে শুরু করে রাশিয়ার ভ্লাদিকাভকাজ পর্যন্ত ২১২ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক। স্থানীয় অধিবাসীরা একে ‘মিলিটারি রোড’ বলে ডাকে। সোভিয়েত শাসনামলে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাত ধরে নির্মিত হয়েছিল এ দীর্ঘ সড়ক। জর্জিয়াসহ প্রতিবেশি দেশগুলো এ রাস্তা ধরে দীর্ঘ দিন ধরে সড়ক পথে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য করছে। সড়কের উল্টোপাশে পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে বয়ে চলা সরু রাস্তার ওপর লম্বা পাইপলাইন দেখতে পেলাম। নিনো জানালেন, পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে রাশিয়া আর্মেনিয়াকে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করে। রাস্তার দুই ধারে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানাও দেখতে পেলাম। জর্জিয়াতে অর্থোডক্স খ্রিস্টানিটির প্রভাব অত্যন্ত জোরালো। বলা হয়, জর্জিয়া এ পৃথিবীতে প্রথম দিককার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি যারা খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। জর্জিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য অর্থোডক্স চার্চের কোনও কোনওটি তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত। নিনো জানালেন, খ্রিস্টধর্ম প্রসারের পাশাপাশি এ সসব অর্থোডক্স চার্চগুলোকে স্থানীয় অধিবাসীরা প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করতো। এজন্য অনেক সময় এসব চার্চকে ‘ফোরট্রেস’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে শাসনকার্য পরিচালনার ভারও এ সকল চার্চের ওপর ন্যস্ত ছিল। নিনোর সাথে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল জিনভালি লেইক। চারদিকে পাহাড়বিশিষ্ট এ লেইকটির সৌন্দর্য সত্যি অসাধারণ, মেঘলা দিনে আকাশের নীল রং সেভাবে প্রতিফলিত হচ্ছিল না। তাই লেইকের পানিও ছিল অনেকটা বর্ণহীন। সোভিয়েত শাসনামলে এ লেইককে ঘিরে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে উঠেছিল, যা ব্যবহার করে জর্জিয়া আজও বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করে। নিনো আমাদের সবাইকে ছবি তোলার জন্য দশ মিনিট সময় দিলেন। লেইকের সামনে থেকে নিজের ছবি নিলাম, টেওকে-ও নিজের ডিএসএলআর ক্যামেরার সাহায্যে কয়েকটি ছবি তুলে দিলাম। পরে নিনো এসে আমাদের দুইজনকে এক ফ্রেইমে রেখে আরও কয়েকটি ছবি তুলে দিলেন। টেও গতানুগতিক ধারার এক জর্জিয়ান তরুণী। জর্জিয়ার বেশিরভাগ তরুণী অত্যাধিক মাত্রায় ইন্সস্টাগ্রামের প্রতি আসক্ত। এ কারণে তারা বিভিন্ন আঙ্গিকে ছবি তুলতে ভালোবাসেন। ছবির ক্ষেত্রে তারা বেশ সংবেদনশীল, কোথাও একটু খুঁত থাকলে তারা বেশ রেগে যায়। পোশাক-আশাক কিংবা মেইকআপের দিক থেকে জর্জিয়ান তরুণীরা বেশ স্মার্ট। রূপ-লাবণ্যের দিক থেকেও তারা যোজন যোজন এগিয়ে। টেও এসব দিক থেকে কোনো অংশে ব্যতিক্রম ছিলেন না। জিনভালি লেইকের পর আমাদের গন্তব্য ছিল আনানুরি কমপ্লেক্স। আরাগভি নদীর তীরে অবস্থিত এ কমপ্লেক্সটি মধ্যযুগীয় স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন। এক সময় এ স্থান থেকে আশেপাশের অঞ্চলের শাসন কাজ পরিচালিত হয়। বিভিন্ন সময়ে এ কমপ্লেক্সটি শত্রুর আক্রমণের শিকার হয়েছে। নুড়ি অঞ্চলে জন্ম নেওয়া ‘আনা’ নামক এক নারীর নামানুসারে এ দুর্গটির নাম রাখা হয়েছে আনানুরি। এর ভেতরে একটি গোপন সুড়ঙ্গ রয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরা বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে এ সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করছিলেন। হঠাৎ করে বাইরে থেকে আসা শত্রুরা এ অঞ্চলে আক্রমণ করলে তারা এ সুড়ঙ্গ পথ ধরে অন্যত্র পালিয়ে যেতেন। এছাড়াও বহির্শত্রুর হাতে বন্দি হওয়া গ্রামবাসীদের কাছে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয় জলের সরবরাহ নিশ্চিত করতেও এ গোপন সুড়ঙ্গ পথ ব্যবহার করা হতো। আনা তার জীবনের বিনিময়ে এ সুড়ঙ্গ পথটিকে রক্ষা করেছিলেন। শত্রুরা তাকে বন্দি করে এবং তার থেকে এ গোপন রাস্তা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। আনাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়, কিন্তু আনা শেষ পর্যন্ত তাদেরকে কোনো ধরণের তথ্য সরবরাহ করার পরিবর্তে সরাসরি আত্মাহুতি দেন। তাই তার সম্মানে এ ফোরট্রেসের নাম রাখা হয় ‘আনানুরি’। দুইটি দুর্গের সমন্বয়ে আনানুরি কমপ্লেক্স। এর মধ্যে একটি দুর্গের নাম শেউপোভারি। শেউপোভারির উপরিভাগকে আমার কাছে বর্গাকার মনে হয়েছে। এ দুর্গটি আজও অক্ষত রয়েছে, তবে আনানুরি কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকা অপর দুর্গটি কালের পরিক্রমায় এবং বহির্শত্রুর আক্রমণে অনেকাংশে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। গোলাকার চূড়াবিশিষ্ট এ দুর্গটি তাই কেবল অতীতের দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
এছাড়াও কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত অন্যান্য ভবনের রয়েছে দুটি অর্থোডক্স চার্চ। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরানো চার্চটি সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত। ইটের তৈরি এ চার্চটির উপরিভাগকেও বর্গাকার দেখায়। কয়েকজন স্থানীয় শাসককে এ চার্চের পাশে সমাহিত করা হয়েছে। ফোরট্রেস কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকা অপর চার্চটি আয়তনের দিক থেকে বেশ বড়। এ কারণে এ চার্চটিকে ‘গ্রেটার চার্চ অব দ্য মাদার অব গড’ নামে ডাকা হয়। আনানুরি ফোরট্রেস পরিদর্শন শেষে আমরা স্টেপানটস্মিদার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। যাত্রাপথে নিনো আমাদের মিনিবাসের ড্রাইভারকে এক রেস্তোরাঁর সামনে থামতে বললেন। দুপুরের খাবারটা সেখানে সেরে নিলাম। কিঙ্কালি, খাচাপুরি ও ভেড়ার মাংসের কাবাবের সমন্বয়ে মধ্যাহ্নের ভোজটা অসাধারণ ছিল। পানীয় হিসেবে ছিল জর্জিয়ার বিখ্যাত লেমোনেড। কিঙ্কালি এবং খাচাপুরি জর্জিয়ার সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী দুইটি খাবার। কিঙ্কালির সাথে নেপালের বিখ্যাত খাবার মমোর অনেকাংশে সাদৃশ্য রয়েছে। অন্যদিকে খাচাপুরিকে জর্জিয়ান পিজ্জার সাথে তুলনা করা যায়। ময়দার তৈরি খামিরের ওপর বিভিন্ন ধরনের পনির দিয়ে একে ওভেনে বেইক করে চুলায় সেঁকে তৈরি হয় খাচাপুরি। জর্জিয়ানরা নিজস্ব স্টাইলে কাবাব তৈরি করে। তবে জর্জিয়ান কাবাব তুর্কি, পারস্য কিংবা লখ্নৌতে তৈরি হওয়া কাবাবের মতো একেবারে তুলতুলে ও নরম নয়। কিছুটা শক্ত প্রকৃতির। কাবাবের ওপর পাতলা রুটি মুড়িয়ে জর্জিয়ানরা কাবাব পরিবেশন করে। নিনোর পরামর্শে ভেড়ার মাংসের কাবাব অর্ডার করেছিলাম। কাজবেগিসহ আশেপাশের পর্বতময় অঞ্চলগুলো উৎকৃষ্ট জাতের ভেড়া উৎপাদনের জন্য গোটা দেশজুড়ে বেশ বিখ্যাত। এছাড়াও পাহাড়ের গা ঘেঁষে প্রবাহিত নদী ও লেইকগুলো ট্রট মাছের অভয়াশ্রম। নিনো আমাদেরকে এ মাছের সাহায্যে রান্না হওয়া পদ থেকে যেকোনও একটি চেখে দেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। দুপুরের খাবার শেষ করে আমরা সবাই মিনিবাসে স্টেপানটস্মিদার পথে যাত্রা শুরু করলাম। পৌঁছানোর আগে আমাদের মিনিবাস আরও এক জায়গায় এসে থামলো। মিনিবাস থেকে বের হতে না হতে এক বিস্তীর্ণ জলরাশিকে কালো ও সাদা এ রঙে বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হতে দেখলাম। নিনো জানালেন, ককেশাস পর্বতমালার দক্ষিণের ঢাল বেয়ে উৎপন্ন হওয়া আরাগভি নদী এ স্থানে এসে দুই অংশে বিভক্ত হয়েছে। সাদা অংশের নাম ‘টেটরি আরাগভি’ বা ‘হোয়াইট আরাগভি’ এবং কালো অংশের নাম ‘শাভি আরাগভি’ বা ‘ব্ল্যাক আরাগভি’। নদীর তলদেশে স্যান্ডস্টোন থেকে শুরু করে স্লেট ও চুনাপাথরের উপস্থিতি আরাগভি নদীর দুই অংশকে দুই ভিন্ন বর্ণে বিভক্ত করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, আরাগভি নদীর এ দুই অংশের জলপ্রবাহ কখনও একে অপরের সাথে মিলিত হয় না। সব সময় দুই রঙের দুইটি ভিন্ন স্তর গঠনের মাধ্যমে স্বতন্ত্রভাবে তারা প্রবাহিত হয়। তেল কিংবা প্রাকৃতিক গ্যাসে জর্জিয়া স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, দেশটিতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবারহ আসে প্রতিবেশি দেশ আজারবাইজান থেকে। তবে আরাগভি নদীর পানিকে জর্জিয়ানরা অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করেন। তাদের মতে, এ নদী নাকি এ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুমিষ্ট স্বাদু পানির উৎস। নিনো জানান, ইউএসএসআর পরবর্তী সময়ে কোকোকলা জর্জিয়াতে তাদের ফ্যাক্টরি স্থাপন করে। এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অসংখ্য পর্যটক নাকি জর্জিয়াতে বেড়াতে আসতেন শুধু মাত্র জর্জিয়াতে উৎপন্ন হওয়া কোকাকোলার স্বাদ নিতে। আমেরিকানদের মতে, দেশটিতে উৎপাদিত কোকাকোলা নাকি স্বাদের দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রস্তুত হওয়া কোকাকোলা থেকেও এগিয়ে ছিল! নিনোর দাবি, আরাগভি নদীর সুমিষ্ট জল জর্জিয়াতে উৎপন্ন হওয়া কোকাকোলার স্বাদকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল। ব্ল্যাক এবং হোয়াইট আরাগভির সৌন্দর্য উপভোগ শেষে আমরা গুদাউড়ির রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে থাকি। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জায়গার মধ্যে গুডাউরি অন্যতম, লেখার শুরুতে যে ধরণের প্ৰাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছিলাম তা মূলত এ গুদাউড়ি থেকে শুরু হয়। এ সব পাহাড়ি অঞ্চলের পরিবেশ মেষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের গবাদি পশু পালনের জন্য বেশ উপযোগী, তাই এ অঞ্চলের রাস্তা ধরে ছুটতে থাকলে হরহামেশা মেষ কিংবা গরুর পালের দেখা পাওয়া যায়। শীতকালে গুদাউড়ি ‘স্কি রিসোর্ট’ এ পরিণত হয়। প্যারাগ্লাইডিংয়ের প্রতি যাদের আসক্তি রয়েছে তাদের জন্যও গুডাউরি আদর্শ এক স্থান। পথিমধ্যে মিনিবাস থামিয়ে নিনো আমাদের সাথে এক ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি মূলত মধু উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্ভর করেন। ভদ্রমহিলার পরিবার প্রায় দুই শ বছর ধরে মধু উৎপাদনের সাথে জড়িত। কিভাবে সত্যিকারের মধু শনাক্ত করা হয় সেটি তার কাছ থেকে শিখতে পেরেছি। তার কাছে চার ধরনের ভিন্ন স্বাদের মধু ছিল। আমাদের সবাইকে তিনি তার মধু চেখে দেখার সুযোগ দিলেন। একদল দাবি করেন, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ওয়াইন উৎপাদনকারী দেশের নাম জর্জিয়া। একই সাথে দেশটিতে মধু উৎপাদনের ইতিহাসও কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। জর্জিয়ানদের কাছে মধু লিকুইড গোল্ড হিসেবে সমাদৃত। ২০০৮ সাল থেকে জর্জিয়াতে ক্রমশ বিদেশি পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। আবাসন ও জমির ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্য তুরস্ক, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য ব্যবসায়ীর কাছে দেশটি এখন নয়নের মণি হয়ে উঠেছে। স্টেপানটস্মিদাতে পৌঁছাতে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত ঘরবাড়ি, রেস্তোরাঁ ও হোটেলের দেখা পেলাম। স্টেপানটস্মিদা থেকে রাশিয়ার সীমান্তের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়, তাই জর্জিয়ার মধ্য দিয়ে এ রুট দিয়ে রাশিয়া থেকে যে সব ট্রাক আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, তুরস্ক ও ইরানসহ বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের উদ্দেশ্যে যাতায়াত করে সে সকল ট্রাকের চালকদের বিশ্রামের জন্য সরাইখানা রয়েছে। ‘স্টেপানটস্মিদা’ শব্দটি এসেছে স্টেফান নামক এক ধর্মযাজকের নাম থেকে। ‘স্টেপানস্মিদা’ মূলত কাজবেগি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের সেন্টার হিসেবে পরিচিত। ককেশাস অঞ্চলের সাহিত্যে আলেকজান্ডার কাজবেগি এক সুপরিচিত নাম। আলেকজান্ডার কাজবেগির জন্ম স্টেপানটস্মিদাতে। সোভিয়েত আমলে তার নাম অনুসারে পুরো মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের নাম কাজবেগি করা হয়। ইউরেশিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু পর্বতের মাঝে একটি হচ্ছে কাজবেগি, এ পর্বতেরও নামকরণ করা হয়েছে আলেকজান্ডার কাজবেগির নামানুসারে। কাজবেগির সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা প্রায় ১৬ হাজার ৫৮১ ফুট। তবে কাজবেগির মূল আকর্ষণ হচ্ছে ‘হলি ট্রিনিটি’ নামক এক বিশেষ অর্থোডক্স চার্চ। স্থানীয় অধিবাসীরা একে ‘টিসিমেন্ডা সামেবা’ নামে সম্বোধন করেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭১২০ ফুট উচ্চতায় কাজবেগি পর্বতের কোলে গড়ে উঠা ‘গেরগেটি’ নামের একটি ছোট্ট গ্রামকে চার্চটি নির্মাণ করা হয়েছে। চার্চে পৌঁছাতে হলে দেড় থেকে দুই ঘণ্টার মতো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পায়ে হেঁটে ওপরে উঠতে হয়। যারা ট্র্যাকিং কিংবা হাইকিংয়ে অভ্যস্ত নন, তারা মিনিবাস কিংবা গাড়ির সাহায্যে পুরো পথ পাড়ি দিতে পারেন। আনুমানিক চতুর্দশ শতাব্দীতে এ চার্চটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি একই সাথে ধর্মীয় উপাসনালয় এবং আশ্রম হিসেবে কাজ করছে। সার্বিয়া, গ্রিস, বুলগেরিয়া ও মেসিডোনিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে অবস্থিত অর্থোডক্স চার্চগুলোর তুলনায় জর্জিয়াতে অবস্থিত অর্থোডক্স চার্চগুলো স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে বেশ ভিন্ন। আমার দৃষ্টিতে জর্জিয়াতে থাকা অর্থোডক্স চার্চগুলোকে আকৃতিগত দিক থেকে বেলনাকার এবং সরু মনে হয়েছে। তাছাড়া এসব চার্চের উপরিভাগের গম্বুজগুলো অর্ধ-গোলাকৃতির বদলে আইসক্রিমের কোণের মতো। হলি ট্রিনিটি চার্চ থেকে অপরূপ রূপে ককেশাস পর্বতমালার সৌন্দর্য আমাদের সকলের চোখের সামনে ধরা দেয়। কাজবেগির সর্বোচ্চ শৃঙ্গকেও এখান থেকে দেখা যায়। শরতের দিন হওয়ায় এ সকল পর্বতমালা হলুদ, সবুজ ও কমলা এ তিনের মাঝামাঝি এক রং ধারণ করেছিল। পাহাড়ের উপরিভাগে তুষার জমেছিল। চার্চ থেকে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ঘর-বাড়ি ও দালানকোঠাগুলোকে লেগোর মতো মনে হচ্ছিলো। চার্চের ভেতরের দৃশ্য ছিল বেশ নজরকাড়া, অর্থোডক্স চার্চগুলো সব সময় ইন্টেরিয়রের তৈলচিত্রের জন্য বিখ্যাত। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকায় চার্চের ভেতরে ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। যদিও টেও জর্জিয়ার অধিবাসী, তবুও এর আগে তিনি কখনও কাজবেগিতে আসেন নি। চারপাশের সৌন্দর্য তাকে এতোটা বিমোহিত করেছিল যে তিনি আমাকে বললে লাগলেন, “রাকিব, একটা বাড়ি এখানে বাকি জীবনটা স্টেপানটস্মিদাতে কাটিয়ে দিলে কেমন হয়?”
টেও- এর প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা ছিল না। তবে এতো সুন্দর একটা জায়গাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবে আমারও মন খারাপ হচ্ছিল।
তোলপাড় করা আবহাওয়া৷ উত্তরবঙ্গে আগামী দু -তিন দিনে একাধিক জেলায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিল আইএমডি৷ দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার জেলায় বেশি বৃষ্টি হবে৷ বজ্র বিদ্যুৎ সহ বড় বৃষ্টির সম্ভাবনা জারি রয়েছে৷ এদিকে কালিংম্পং, কোচবিহার, দুই দিনাজপুর, মালদহে ভারী বৃষ্টির ওয়েদার আপডেট রয়েছে৷ মঙ্গলবার এবং বুধবার এই ধরণের আবহাওয়া জারি থাকবে৷ এরই জেরে অ্যালার্ট জারি রয়েছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে৷ এদিকে উত্তরবঙ্গে তোলপাড় করা আবহাওয়ার ছাড়া দক্ষিণবঙ্গ ও কলকাতায় এখন সেভাবে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হবে না৷ সব জায়গাতেও ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা জারি রয়েছে৷ কলকাতায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে থাকবে৷
আপেক্ষিক আর্দ্রতার সর্বোচ্চ পরিমাণ ৮৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রচণ্ডভাবে আর্দ্র৷ এদিকে এই দুই পরিস্থিতির জেরে ফের অস্বস্তিকর আবহাওয়া জারি থাকবে৷ ফিল লাইক তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো এমনটাই ওয়েদার আপডেটে জানিয়েছে অ্যাকুওয়েদার৷ কলকাতায় আজ দিনের একাধিক সময়ে হালকা ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা জারি রয়েছে৷ দিনে থেকে রাত বিভিন্ন সময়ে বৃষ্টির ওয়েদার আপডেট করা হয়েছে৷ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও আকাশ মূলত পরিষ্কার থাকবে৷ ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা জারি থাকছে সব জেলাগুলিতেই৷ তবে ভারী বা মাঝারি বৃষ্টিপাতের চান্স কম থাকবে৷ এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মতো দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বৃষ্টির পূর্বাভাস জারি করেছে আইএমডি৷ দিল্লি, এনসিআর, উত্তরপ্রদেশ, উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অংশে ভারী বৃষ্টি জারি থাকবে৷ বৃষ্টি হবে মহারাষ্ট্রে৷ স্কাইমেট ওয়েদার আপডেটে জানিয়েছে আগামী ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি জারি থাকবে৷ যার জেরে আস্তে আস্তে তাপমাত্রা অনেকটা নামবে৷ এবং আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা পড়া শুরু হতে পারে৷
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন বা ভারত বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন বা বাংলাদেশ-ভারত পাইপলাইন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তেল পরিবহনের লক্ষ্যে নির্মাণাধীন একটি পাইপলাইন। পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আনার লক্ষ্যে ২০২০ সালে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন প্রকল্পের পাইপলাইন স্থাপনের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। ১৩১.৫০ কিলোমিটার পথে পাইপলাইন স্থাপন কাজ শেষ হলে ভারতের নুলাইবাড়ী রিফাইনারি লিমিটেড থেকে সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আসবে দিনাজপুরের পার্বতীপুর তেল ডিপোতে। এতে জ্বালানি তেল সংকট দূর হবে দেশের উত্তরাঞ্চলে। পার্বতীপুর উপজেলার সোনাপুকুর নামক স্থানে এ পাইপলাইন স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করা হয়। ভারতের নুমালীগড় থেকে ১৩১.৫০ কিলোমিটার পাইপলাইনে বাংলাদেশের পার্বতীপুর ডিপোতে ডিজেল আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গত ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এরপর ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি জানান, এ ১৩১.৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ভারতের অংশে পাঁচ এবং বাংলাদেশের অংশে দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত ১২৬.৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হবে। এ প্রকল্পে ভারত ৩৪৬ কোটি রুপি ও বাংলাদেশ ৩০৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা ব্যয় করবে। আগামী ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ায় ভারত থেকে সরাসরি বাংলাদেশ পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানি হবে।
বছরের শুরুতে ভারত থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আসবে বাংলাদেশে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই দেশ। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন স্থাপন প্রায় ইতিমধ্যে শেষ পর্যায়ে। ভারতের শিলিগুড়িতে চলছে ডিজেল সরবরাহের প্রস্তুতি। আর বাংলাদেশের পার্বতীপুর প্রস্তুত হচ্ছে ভারত থেকে আসা ডিজেল সংরক্ষণ ও সরবরাহের কাজ। একই সঙ্গে জ্বালানি তেল সরবরাহের কমিশনিং নিয়েও কাজ করছে দুই দেশ। এই পাইপলাইন প্রকল্পের প্রাক্কলন ছিল ৫২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারত সরকার ৩০৩ কোটি টাকা দেয় এবং বাংলাদেশ সরকার বাকি অর্থ ২১৭ কোটি টাকা দেয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময়কাল ২০২০ থেকে জুন ২০২২ সাল পর্যন্ত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেন। চুক্তি স্বাক্ষরের ১৭ মাস পর ২২ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের প্রথম চালানটি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে আসে। আনুষ্ঠানিকভাবে একই বছরের মার্চের শুরুতে পাইপলাইনের কাজ শুরু হয়। ভারতের লুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড এবং বাংলাদেশের মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা যাবে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ আড়াই লাখ টনের মতো ডিজেল আমদানি করবে এবং পরের বছরগুলোতে এটি ৪ থেকে ৫ লাখ টন পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। চুক্তির অধীনে সরবরাহ শুরু হওয়ার দিন থেকে ১৫ বছরের জন্য বাংলাদেশ ডিজেল নেবে। বাংলাদেশ বর্তমানে লুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় ২ হাজার ২০০ টন ডিজেল আমদানি করে এবং বিপিসি বাংলাদেশ রেলওয়ের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের পার্বতীপুর তেল ডিপোতে জ্বালানি বহন করে এবং পরে ডিজেল গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়। উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভারত থেকে সরাসরি দিনাজপুরের পার্বতীপুরের রেলহেড তেল ডিপোতে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আনার উদ্যোগ নিয়েছে দু-দেশের সরকার। এ লক্ষ্যে ২০১৮ সালে সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । ফলে বৃহস্পতিবার পার্বতীপুরের সোনাপুকুর অংশে পাইপলাইন বসানোর কাজ শুরু হয়। পাইপলাইন ভারতের শিলিগুড়ির নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড থেকে ১৩০ কিলোমিটার ভারতের শিলিগুড়ি, বাংলাদেশের পঞ্চগড়, নীলফামারীর হয়ে পার্বতীপুরে আসবে। তেল সরবরাহ শুরু হলে উত্তরাঞ্চলের অঞ্চলের মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে তেল পাবে।
মহালয়া শব্দের অর্থ মহান আলয় অর্থাৎ মহান আশ্রয়। আবার মহালয়ার অর্থ হিসেবে পিতৃলোককে বোঝায়। এই জগতের স্বর্গতঃ পিতৃপুরুষরা যেখানে থাকেন বলে বিশ্বাস। অর্থাৎ পিতৃলোককে সশ্রদ্ধ স্মরণ করার অনুষ্ঠানই ‘মহালয়া’ নামে পরিচিত। পিতৃপক্ষের শেষ হবার পর, অমাবস্যার অবসান হলে দেবীপক্ষের শুরু হয়। সেই লগ্নটিকেই আমরা মহালয়া বলে থাকি। এই জন্য মহালয়া ‘স্ত্রীকারান্ত’। এই ত্রিভুবনে দেবী দুর্গাই হলেন মহান আশ্রয়। তার আগমনের লগ্নই ‘ মহালয়া ‘। আবার কেউ কেউ বলেন ‘ পিতৃলোক ‘ হল সেই মহান স্থান। মহালয়া হল পিতৃপূজা ও মতৃপূজার সন্ধিক্ষণ। আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের শেষ ও দেবীপক্ষের শুরুতে যে অমাবস্যা আসে, তাকেই মহালয়া বলে অভিহিত করা হয়। মহালয়ার দিন একসাথে আমরা পিতৃপূজা ও মাতৃপূজা দুই’ই করে থাকি। তাই মানব জীবনে, মানব মননে এই দিনটি এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আনে। ভারতীয় ঐতিহ্যের এ এক অপূর্ব অনুভূতি। মহালয়া থেকে দুর্গাপূজার দিন গোনা শুরু হয়ে যায়। মহালয়ার ছয় দিন পরেই আসে মহাসপ্তমী। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন। লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের অভিলাষ নিয়ে। শরতের এই পূজাকে দেবীর অকাল বোধন বলা হয়। কারণ শ্রীরামচন্দ্র পূজাটি করেছিলেন অকালে, অসময়ে। আসল দুর্গাপূজা হলো বসন্তে তাই একে বাসন্তী পূজা বলা হয়। শোনা যায় সুরথ রাজা এই আসল পূজাটি করেছিলেন বসন্ত কালে। কোন শুভ কাজ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বজসহ সমগ্র জীব জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এটাই বিশ্বাস। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। এর পোশাকি নাম ‘তর্পণ”। তর্পণ মানে সন্তুষ্ট করা। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আশায় বুক বেঁধে এমনই করেছিলেন। যুগ যুগ ধরে এই ভারতের কোটি কোটি মানুষ মহালয়ার প্রভাতে তিন গন্ডুষ জলের অঞ্জলি দিয়ে আসছেন। আর আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়ে উঠছে – ” ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যন্ত ভূবন এয়ম, আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্যন্তং তৃপ্যন্ত ” -এই মন্ত্র। যার মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে চলেছেন তাদের বিদেহী পিতৃপুরুষ এবং পূর্বপুরুষদের। পুরাণে বলা আছে মহালয়ার দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার দায়িত্ব পান। ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত কোন মানুষ বা কোন দেবতার পক্ষে মহিষাসুরকে বধ করা সম্ভব ছিল না । ফলত অসীম ক্ষমতাশালী মহীষাসুর তার ক্ষমতার দম্ভে মদমত্ত হয়ে ওঠে। একে একে দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে। অঘোষিত ভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর হয়ে ওঠার বাসনা তাকে পেয়ে বসে । ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব ত্রয়ী তখন বাধ্য হয়ে মিলিতভাবে ” মহামায়া ” র রূপে অমোঘ নারী শক্তি সৃষ্টি করলেন। দেবতাদের দান করা দশটি অস্ত্রে সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা সুসজ্জিত হয়ে উঠেন। নয় দিন ব্যাপী ঘোরতর যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করলেন। এভাবেই অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির জয় প্রতিষ্ঠা পায়। যুগের পর যুগ এই বিশ্বাস, এই ধারা বয়ে আসছে । মহালয়া যেন তারই পরিচয় বহন করে চলেছে। মহালয়া হচ্ছে সেই দিন যেদিন দেবী দুর্গা এই মর্ত্যে অবতরণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস। তিনি এসেছিলেন সমস্ত অশুভ শক্তিকে পরাজিত করতে। মহালয়া পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনা বলে মহালয়াকে দুটি গতিশীল বা চলমান উৎসবের সমাহার বা সম্মিলনও বলা যেতে পারে । হিন্দু পুরাণ মতে এই সময় পিতৃপুরুষের আত্মার স্বর্গ-প্রাপ্তির জন্য পুত্রের দ্বারা শ্রাদ্ধক্রিয়া করা আবশ্যক যাকে বাংলায় বলা হয় ‘ তর্পণ’। প্রাকভোর বা প্রাতঃকালে নদীতে পুত্র তার পিতৃপুরুষদের উদ্দ্যেশ্যে ‘পিণ্ডদান ‘ করে থাকে। আসলে তা জল ও খাদ্য প্রদানের চেষ্টা ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
দেবীপক্ষ মানে দেবীকাল। দেবী দুর্গা প্রধান পূজার সাতদিন আগেই মর্ত্যে আসেন। চারদিন ধরে চলা মহাপূজার দিনগোনা শুরু হয় মহালয়ার পূণ্যলগ্ন থেকেই। আর সমগ্র ভূভারতে পূজার ঢাকে কাঠি পড়ে যায় । হিন্দুমতে ভাদ্রের অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়কালকেই দেবীপক্ষ বলে মানা হয়। বিশ্বাস করা হয়, হিন্দুদের জন্য কোন পবিত্র কাজ করার শ্রেষ্ঠ সময নাকি এটাই। উত্তর ভারতে অমাবস্যা পরবর্তী নয়দিনকেই নবরাত্রি হিসেবে পালন করা হয়। অমাবস্যার শেষ দিনে দুর্গাপ্রতিমার চোখ অঙ্কিত করা হয়। যা ‘চক্ষুদান’ নামে পরিচিত । মহালয়া অন্য এক বর্ণনা পাওয়া যায় মহাভারতের কাহিনীতে। দাতা কর্ণের মৃত্যুর পর তার কৃত শুভকর্মের জন্য তিনি স্বর্গপ্রাপ্ত হন। সেখানে কর্ণ ক্ষুধার্ত হলে তাকে প্রচুর সোনা, রুপা দেওয়া হয়। তিনি জীবিতকালে সকলকে তাই দিয়ে আসতেন। ক্ষুধার্ত কর্ণ হতাশ হন এবং খাবার চান। যমরাজ তখন বলেন জীবিতকালে কর্ণ মানুষকে কেবল সোনা দানাই দিতেন। কিন্তু পূর্বজদের কখনো খাবার ও জল দেননি। কর্ণ নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করেন ও ক্ষমা চান। তখন যমরাজ তাকে চোদ্দ দিনের জন্য মর্ত্যে ফেরত পাঠান। কর্ণ মর্ত্যে এসে মানুষকে খাবার প্রদান করেন। পূর্বজদেরও খাদ্য উৎসর্গ করেন। মানুষের আসল প্রয়োজনটা অনুধাবন করতে পারেন। অনেকে বলেন এই চোদ্দ দিনও ‘মহালয়া’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মহালয়ার প্রভাতে বা ভোরে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় মহিষাসুরমর্দিনীর আগমনী গান। ঘরে ঘরে বেজে ওঠে ‘ জাগো তুমি জাগো ‘- এর সুর। এর মধ্যে দিয়ে মাকে যেন জাগ্রত হওয়ার করুণ আবেদন জানানো হয়। যাতে মা আবির্ভূত হয়ে এই মর্ত্যধামের সকলের ক্লেশ দূর করেন। মহালয়ায় ‘পূর্বপুরুষদের উদ্দ্যেশ্যে বছরে একবার জলদান করা হিন্দুমতে অত্যন্ত আবশ্যক হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ প্রেতলোকে একদিন আমাদের মর্ত্যের হিসেবে এক বছর কালের সমান বলে বিশ্বাস। আর পূর্বপুরুষরাও নাকি সামান্য জলেরই প্রত্যাশা করেন। এই পূণ্যলগ্নে সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী সব একে অপরের অত্যন্ত কাছাকাছি চলে আসে।’ মহালয়া যেন এক বিশ্বাস। যুগ যুগ ধরে বয়ে আসা এক অমোঘ বিশ্বাস । যা আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের ধারনাকেই প্রতিষ্ঠিত করছে। যা এই মর্ত্যে জীবিতকালেও প্রতিফলিত হয়ে থাকে । মহালয়ার তর্পণ যুগ যুগ ধরে যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। ভারতীয় সংস্কৃতির এক স্তম্ভ । ধারক এবং বাহক। এর গুরুত্ব অমলিন এবং অক্ষত যা ভাবীকালেও অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে মনে হয়।